হয়ে ওঠা মানে নিজেকে নির্মাণ করা। আপওয়ার্কের একটা অংশ হতে হলে অবশ্যই আপনার পাথেয় লাগবে। এটা না থাকলে নিশ্চিত হাতড়ে মরবেন। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপনি সঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন। সর্বাগ্রে আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই এমন একটা অভিজাত ইচ্ছা পোষণের জন্য! প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আপওয়ার্ক (Upwork) প্রকৃতই সম্মানের দাবিদার। একইসাথে এটা বেশ চ্যালেঞ্জিংও বটে! নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আজ কিছু দিক-নির্দেশনা আমি আপনাকে দেবো।

এক নজরে আমাদের বিষয়বস্তুগুলোঃ

আপওয়ার্ক কি

আপওয়ার্ক পৃথিবীর বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড়ে এখানে প্রায় তিন মিলিয়ন জব পোস্ট করা হয়েছে, যার অর্থমূল্য এক বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি। এটি একটি যুক্তরাষ্ট্র (USA) ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু যেহেতু ইন্টারনেটের কোনো সীমান্ত নেই এবং বিজ্ঞানে আছে সকল সভ্যতার অবদান, তাই আপনি এটাকে নিজেরই ভাবতে পারেন। এখানে উদ্যোক্তা এবং সেবাদানকারী একে অপরের শরণাপন্ন হন নিজ নিজ ব্যবসা পরিচালনার উদ্দেশ্যে। এখন পর্যন্ত আপওয়ার্কে সারা বিশ্বের ৫ মিলিয়নেরও অধিক রেজিস্টার্ড ক্লায়েন্ট এবং ১২ মিলিয়নেরও অধিক রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন।

কিভাবে নিজেকে নতুনরুপে গড়বেন

সৃজনশীলতা মানে শুধু ডিজাইনিং বা লেখালেখি নয়। এটা মূলত প্রগতিশীল পরিবর্তনের বিষয়। আপনি নবাগত হন বা বেশ প্রফেশনাল, আপনাকে আপওয়ার্কে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। শিখতে হবে অনেক ব্যাপার। জানেন তো প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। সেই ছাঁচে নিজেকে গড়ে নিতে হয়। এর জন্য নিজে নিজে শিখতে হয়, অভিযোজনের যোগ্যতা থাকতে হয়। অবশ্য নিজেকে দ্রুত খাপ খাওয়ানোর জন্য অভিজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারেন।

কিভাবে একটা দুর্দান্ত প্রোফাইল বানাবেন

আপনি আপওয়ার্কে আছেন মানে পৃথিবীর বৃহত্তম মার্কেটপ্লেসে আছেন। তাই সর্বাগ্রে নিজের টার্গেট মার্কেটটি চিহ্নিত করুন। এবং অবশ্যই সেটা নিজের দক্ষতার আলোকে। আবিষ্কার করুন, এই গ্লোবাল ভিলেজকে দেবার মতো কোন সেরা জিনিসটা আছে আপনার। কেবল তারপরই অর্থ উপার্জনের কথা ভাবুন। প্রোফাইলে একটা হৃষ্টপুষ্ট পোর্টফোলিও অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। ক্লায়েন্টকে দেখানোর মতো কোনো কাজ যদি আপনার না থেকে থাকে তো চিন্তা করবেন না। স্যাম্পল বানান। তবে জব বোর্ডের সাথে সঙ্গতি রেখে স্যাম্পল বানানো বুদ্ধিমানের কাজ। এটা আপনাকে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে রাখবে। আর প্রোফাইল ক্রমাগত আপডেট করতে থাকুন। শ্রীবৃদ্ধির কোনো শেষ নেই। নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলুন। তবে বাড়িয়ে দেখাবেন না। সৎ থাকুন। আপওয়ার্কে সততার বিকল্প নেই। আর একটা ইন্ট্রোডাক্টরি ভিডিও তৈরি করুন। ক্লায়েন্টদের আহ্বান জানান নিজ কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে। এসময় শরীরে কোনো ক্যাজুয়াল-বিজনেস পরিচ্ছদের পাশাপাশি হাসিমুখ করতে ভুলবেন না।

মুগ্ধকর প্রোপোজাল লিখুন

দেখুন, আপওয়ার্কে এই ব্যাপারটার তাৎপর্য অনেক। প্রোফাইল কমপ্লিট করেছেন ভালো কথা, এর পরপরই কিন্তু আপনাকে ক্লায়েন্টের আঙিনায় পা রাখতে হবে এবং সেটা যথাযথভাবে। জব পাবেন কি পাবেন না তা অনেকটাই নির্ভর করে এই প্রোপোজাল লিখতে পারার উপর। তবে এটা নিয়ে মাথাব্যথার কিছু নেই। স্রেফ ইংরেজিতে গুগল করুন ‘কিভাবে আপওয়ার্কে প্রোপোজাল লিখতে হয়। ব্যস, এরপর সব সেরা আর্টিকেল থেকে নোট নিন। শিখুন কিভাবে সংক্ষেপ করতে হয়, কিভাবে সম্ভাষণ জানাতে হয়, কিভাবে শুরু, শেষ বা মাঝের অংশটা লিখতে হয়। প্রোফেশনাল হবার পাশাপাশি হয়ে উঠুন বন্ধুসুলভ। ক্লায়েন্টরা আগের চেয়ে এখন অনেক স্মার্ট। জব পোস্টে তারা কিছু প্রশ্ন রাখবে আপনাকে যাচাই করবার জন্য। নিশ্চিত করুন আপনার প্রোপোজালে যা, প্রোফাইলেও তাই!

অনলাইন ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বারোপ

আমাকে বলুন, আপনার খুব বিশেষ কিছু থাকলে কি করেন আপনি। নিশ্চয়ই খুব খেয়াল রাখেন তাইনা? হ্যাঁ, ওভাবেই নিজের একাউন্টের দেখভাল করতে হবে যদি দিনকে দিন সমৃদ্ধ হতে চান। এটা চলমান প্রচেষ্টার বিষয়। এবং বহুমাত্রিক। তবে আপনার কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে নিঃসন্দেহে সবই এঞ্জয় করবেন। পাশাপাশি উঠতি শিল্প, উঠতি প্রবণতাগুলো পর্যবেক্ষণে রাখুন। মনে রাখবেন ফ্রিল্যান্সিং একটা বিজনেস। বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখুন, আপনার ব্র্যান্ড আপনার অধিকাংশ কাজে প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা। অন্যদেরকে বলুন আপনার সমালোচনা করতে। তাদের থেকে নিজের পর্যালোচনা নিন। এটা উন্নতির জন্য সহায়ক। জব অফার এবং ক্লায়েন্টের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবগুলোতে ২৪ ঘন্টার ভেতর সাড়া দিন।

প্রোজেক্ট দেখভাল, নিজের দেখভাল

কিভাবে কোনো প্রোজেক্টের দিকে পা বাড়াবেন এ ব্যাপারে ড্যানি মরগিলের একটা উক্তি বেশ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “শুরুতে মনোবল শক্ত রাখুন। ফ্রিল্যান্সিং জবগুলোতে নির্বিচারে হাত দিতে থাকা আপনার দুর্বলতার পরিচয়। বরং কি দিতে পারবেন তার উপর জোর দিন, সেটাই নির্দেশ করে আপনার শক্তিমত্তা।“ ক্লায়েন্টের প্রত্যাশা মেটানো সবকিছুর ঊর্ধ্বে। অতিরঞ্জিত করবেন না। স্বচ্ছতা বজায় রাখার চর্চাটা জরুরি। ক্লায়েন্টের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে যোগাযোগ দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাই তৎপর হোন, সবকিছু সংক্ষেপে সারুন। তবে কাজ বুঝে নিতে ক্লায়েন্টকে প্রশ্ন করতে ভুলবেন না। এটা কিন্তু তারা পছন্দ করে। নিজের সেরাটা দেবার জন্য এটা খুব দরকারী। এরপর ফিডব্যাক বা রিভিউ নেবার ক্ষেত্রেও নম্রতা প্রয়োজন। এছাড়া আর কি কি করা যেতে পারে? চলুন নিজের কথাই বলি। আমি মেসেজ বক্সটায় বিশেষ নজর রাখি। আর কোনো টিমে কাজ করার সময় টিম মেম্বারদের প্রশংসা করি। কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করে একসাথেই উদযাপন করি! বিশেষত প্রোজেক্ট শেষে ক্লায়েন্টকে ‘থ্যাংকইউ নোট’ লিখতে কখনো ভুলি না। এসবের বাইরে সকাল সকাল ওঠা, জিমে যাওয়া, পরিবার বা বন্ধুদের সাথে উল্লাস করা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিক্রয় হোক নান্দনিক উপায়ে

এখানে শুধু প্রোডাক্টিভ নন, আপনি নিজেও একটা প্রোডাক্ট। আপনি আপনার সেরাটাই বিক্রি করছেন। তবে কোনো কিছুই জাদুবলে হবে না। হাসিল করতে হলে আপনাকে শৈল্পিক হতে হবে। তাই যতটা সম্ভব ব্যাপারটাকে নান্দনিক করে তুলুন। আরেকটা ব্যাপার, অতিবাণিজ্য (Overselling) এবং নীচুবানিজ্য (Underselling) দুটোই কিন্ত খারাপ! চার্জ করার ক্ষেত্রে নিজের কদরখানা ঠিকঠাক বুঝতে পারা চাই। এটা আপনাকে পুরষ্কৃত করবে।

মনোভাবের গুরুত্ব অশেষ

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে মনোভাব (Attitude) দক্ষতাকেও হার মানায়। কার্যকরী মনোভাব আপনার এই আপওয়ার্কার হয়ে ওঠায় বিশেষ অবদান রাখবে। এমন মনোভাব পোষণ করুন যে ক্লায়েন্টকে সফল করেই ছাড়বেন! এটা আপনার উৎপাদনশীলতা বাড়াবে। এমনকি অনেক অভিজ্ঞতা না থাকলেও কেবল এই মনোভাবের জোরে কাজ পেয়ে যাবেন। এক্কেবারে সেরা জবগুলোই পোস্ট করা হয় আপওয়ার্কে। তাই ক্লায়েন্টদের সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণই বুদ্ধিমানের কাজ।

যে ভুলগুলো অবশ্যই এড়াবেন

আপওয়ার্ক ইউজার হিসেবে অবশ্য পালনীয় ব্যাপার রয়েছে। কেবল ভিডিও ইন্টারভিউয়ে ভেরিফায়েড হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। উল্লেখযোগ্য সীমালংঘনগুলো হচ্ছে অস্পষ্ট পরিচিতি (Identity Uncertainty), আপওয়ার্কের বাইরে ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ বা পেমেন্ট গ্রহণ, কাজ সম্পন্নে ব্যর্থ হওয়া, হয়রানি করা, এমনকি ফিডব্যাকের জন্য ক্লায়েন্টকে চাপ দেয়াটাও গুরুতর সীমালঙ্ঘন বলে বিবেচিত হয়। এসবের যে কোনো একটা কারণেই আপনার প্রোফাইল খোয়া যেতে পারে!

সফলতার আত্ম-সমালোচক

আত্ম-সমালোচনা ছাড়া সফল হতে পারবেন না। কেন বলছি? কারণ আপওয়ার্কসহ সবখানে সফল হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটাই মূল চাবিকাঠি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফ্রিল্যান্সাররা কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করে না। তারা চূড়ায় ওঠার আকাঙ্ক্ষা রাখে। তাই যাইই পড়বেন ধর্মগ্রন্থের মতো পড়বেন এবং কাজগুলো সাবমিটের আগে অনেক অনেক এডিট করবেন। ভুলগুলো থেকে শিখুন। আত্ম-সমালোচক হওয়া মানে নিজেই নিজের শিক্ষক হওয়া। ক্লায়েন্টের সমালোচনা পজিটিভলি নিন। এটাও আত্ম-সমালোচনার অংশ।

আপওয়ার্কে ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠা মানে নিজেই নিজের ব্যবসাটাকে দাঁড় করানো। সভ্যতার সূচনাই হয়েছে বিনিময় তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে। এভাবে আপনিও অংশ নিতে পারেন মানবতার সেই গর্বের জায়গাটায়।