শহিদুল আলম খান সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পড়াশোনা শেষ করে দীর্ঘ ১২ বছর কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন ফুলটাইম ফ্রিলান্সার যিনি অস্ট্রেলিয়ান একটি কোম্পানিতে টেন্ডার ম্যানেজার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছেন। ফ্রিল্যান্সিং শুধু বর্তমানে তার পেশাই নয়, তিনি ফ্রিল্যান্সিং কে ভালোবাসেন তার পরিবারের মতো। কীভাবে ফ্রিল্যান্সিং তার এতো কাছের হয়ে উঠলো চলুন শুনে আসা যাক সেই কথা।
ফ্রিল্যান্সিং শুরু কীভাবে হয়েছিলো?
শহিদুল আলম খান কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করার সময় স্কয়ার, শেলটেক, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি সহ এর আরো মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছেন। তিনি এই কাজ করেছেন ১২ বছর ধরে, ২০১৩ সাল পর্যন্ত। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তার কাজগুলো ছিলো প্রধানত প্রজেক্ট বেসিস এর। এসময়ই তিনি প্রথম তার স্ত্রীর মাধ্যমে জানতে পারেন তার শ্যালিকা ইন্টারনেটে কাজ করে টাকা উপার্জন করছেন। তখনও তিনি ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে তেমন কিছুই জানেন না এবং বিষয়টিকে নিতান্ত গল্প বলেই মনে করছিলেন। এরপর ২০১৩ সালের দিকে তিনি অর্থাভাবে পড়েন এবং তখন তার পরিবারে নতুন সদস্য হতে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে। হসপিটাল ফী, নবজাতকের দেখাশোনার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কোথাথেকে জোগাড় করবেন তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এসময় তিনি স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ফ্রিল্যান্সিংয়ে অর্থোপার্জনের চেষ্টা করেন।
২০১৩ সালের এই ঘটনার সময় ওডেস্ক বা বর্তমান আপওয়ার্ক এ তিনমাস পরিশ্রম করে কাজ শিখে তিনি প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করতে পেরেছিলেন। এরপর থেকেই ফ্রিল্যান্সিং হয়ে যায় কাজের পাশাপাশি বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো। তারপর তিনি কিছুদিন আরেকটি কর্পোরেট জব করছিলেন ও কাজ শিখে জবের পাশাপাশি ওডেস্ক এ কাজ করতেন। এরপর তিনি বুঝতে পারেন কর্পোরেট সেক্টরে শ্রম ও সুযোগ-সুবিধার তুলনায় ফ্রিল্যান্সিং এ তা অনেক বেশি এবং অর্থোপার্জন ও ভালোভাবে করতে পারছেন। এরপর ২০১৮ সাল থেকে তিনি ফুলটাইম ফ্রিলান্সার হিসেবে আপওয়ার্কে কাজ করা শুরু করেন।
শুরুটা কতো কঠিন ছিলো?
শহিদুল আলমের শুরুটা বেশ কঠিনই ছিলো। ২০১৩ সালে যখন তিনি শুরু করতে যান তখন তিনি ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে তেমন কিছুই জানতেন না। কর্পোরেট অফিস সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলেও ওডেস্ক এ তিনি একেবারেই নতুন। নতুন করে সব শিখে কাজ এ যোগদিতে অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য ধারণ করতে হয়েছে। প্রথম যে কাজটি পান সেটি ছিলো মাত্র ৩ ডলার পার আওয়ার। তার এই প্রথম ক্লায়েন্ট ছিলেন অনেক বয়স্ক, অসুস্থ থাকায় তিনি নিয়মিত কাজ দিতে পারতেন না এবং ডীলে ক্লস হিসেবে তাকে বোনাস দিতেন। কিন্তু কিছুদিন পর এই ক্লায়েন্টের মৃত্যু হয় এবং তার কাজটিও বন্ধ হয়ে যায়। কাজটি ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং নকশা করে দেয়ার। এরপর অস্ট্রেলিয়া থেকে একটি টেম্পরারি জব পান, যেখানে লং–টার্ম এ হায়ার করার জন্য আগে ক্লায়েন্ট কাজ যাচাই করে নিতেন। এই প্রজেক্টটি তিনি পেয়ে যান। ইতোমধ্যে তিনি ইউএসএ, ইউকে, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের অনেক ক্লায়েন্ট এর সাথে কাজ করেন এবং বেশ ভালো ফিডব্যাক পেতে থাকেন।
কেন ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সিং?
কিছুদিন ফ্রিল্যান্সিং করার পর বাংলাদেশি সনামধন্য একটি কর্পোরেট অফিসে জবের অফার পান। স্যালারির পাশাপশি আরো অনেক সুবিধা দিয়ে থাকেন তারা। শহিদুল আলম খান এসময় দিনে অফিস ও রাতে ফ্রিল্যান্সিং করে অনেকটুকু সময় এর পিছনেই ব্যয় করতেন। এসময়ই তিনি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি থেকে পার্মানেন্ট জবটির অফার পান তাদের কাজের এস্টিমেশন করার এবং কাজটি তিনি পেয়েও যান। তারা তাকে পরবর্তীতে ফুলটাইম কাজে যোগ দেয়ার অফার করেন এবং জব ও ফ্রিল্যান্সিং এর মধ্যে শহিদুল ফ্রিল্যান্সিংকেই বেছে নেন। এর কারণ ছিলো অফিসের প্রেশার, ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম, ফিল্ড সুপারভিশন এর প্রেশার থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। ফ্রিল্যান্সিং এ তিনি আরনিং ভালো করতে পারছিলেন সাথে সাথে কাজের স্বাধীনতা ও পরিবারের জন্যও সময় বের করতে পারছিলেন। তাই তিনি ফুলটাইম ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।
অনুপ্রেরণার জন্য বিশেষ কেউ কী আছেন?
ফ্রিল্যান্সিং এ আসার গল্পটি শহিদুলের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন। সাধারণত এতো দীর্ঘ সময় জব করে কেউ ফ্রিল্যান্সিং এ এসে পুরোপুরি নিয়োজিত হন কম। এর পিছনে কিছু অনুপ্রেরণা বা সাপোর্ট অনেক বড় একটা ভূমিকা পালন করে। ফ্রিল্যান্সিং এ আসার পিছনে শহিদুল আলম প্রধান অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার সহধর্মিণীর কাছ থেকে৷ ২০১৩ সালে প্রথম শুরু করা থেকে ২০১৮ সালে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্সিং এ যুক্ত হওয়ার পিছনে তার স্ত্রীর ও পরিবারের সাপোর্ট রয়েছে। তিনি তার শিক্ষিকা বড় বোনের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তিনি শহিদুলকে সকল ভালো কাজের সময় পাশে থেকে সাপোর্ট দিয়েছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন।
নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কিছু কথা?
শহিদুল আলমের নতুন ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি সাজেশন্স হচ্ছে, প্রথমত, অবশ্যই স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। তিনি যখন শুরু করেন তখন ইনফরমেশন কম এভেইলেবল ছিলো৷ কিন্তু বর্তমানে অনেক ওপেন প্ল্যাটফর্ম এ অনেক ইনফো, ভিডিয়ো টিউটোরিয়ালস, কোর্সেস ইত্যাদি পাওয়া সম্ভব। তাই প্রচুর স্কিলড ওয়ার্কারস রয়েছে সারা বিশ্বব্যাপী। আর ফ্রিল্যান্সিংও একটি কাজের মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। দক্ষ যে কেউ কাজ পেতে পারে। তাই কারো স্কিল যত ভালো হবে তার তত সফলতার হার বেশি।
আর কী কী সফটওয়্যার প্রয়োজন সেসকলের ব্যবহার ভালোভাবে আয়ত্ত করা, ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাজের টাইম ম্যানেজমেন্টের উপর তিনি জোর দেন। ফ্রিল্যান্সিং এ আসতে হলে এসব বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা চাই।
ক্লায়েন্টদের খুশি রাখতে কিছু টিপস?
শহিদুল আলম খানের মতে কিছু বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা উচিত যেগুলো ক্লায়েন্টকে স্যাটিসফাই রাখতে পারে। যেমন–
১. ডেডলাইন এর মধ্যে কাজ জমা দেয়া: শহিদুল প্রথমেই যে বিষয়টিতে ফোকাস করেন তা হলো, অবশ্যই ক্লায়েন্ট এর সাথে যে ডেডলাইনের চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে কাজ জমা দেয়া উচিত। সম্ভব হলে ডেডলাইনের আগেই কাজ দিয়ে দিন। তবে অবশ্যই কাজ ভালোভাবে শেষ করে।
২. কাজ জমা দেয়ার আগে রিভিউ করে নেয়া: দ্বিতীয়ত তিনি কাজ রিভিউ করার উপর জোর দেন। কাজ শেষ করে ভালোভাবে পুরোটা দেখে নিন যে ক্লায়েন্ট এর সব রিকোয়ারমেন্ট ফিল আপ করেছেন কিনা। আর রিভিউ এর মাধ্যমে কোন ভুল থাকলেও তা ধরা পড়ে যায়। এতে ক্লায়েন্ট এর কাছ থেকে রিভিউও ভালো আসে।
৩. প্রজেক্ট রানিং অবস্থায় আপনি কোন নতুন আইডিয়া দিয়ে ক্লায়েন্টকে হেল্প করতে পারেন: আপনি যে প্রজেক্টটি নিয়েছেন সে বিষয়ে সবসময় ক্লায়েন্টের জ্ঞান আপনার চেয়ে ভালো থাকবে এমন কোন কথা নেই। হয়তো আপনি প্রজেক্টটির জন্য আরো কোন ভালো আইডিয়া পেয়েছেন যাতে কাজটি আপনার ও আপনার ক্লায়েন্ট দুজনের জন্যই সুবিধার হয়ে যায়। এই আইডিয়া আপনার ক্লায়েন্টের সাথে শেয়ার করুন। তাতে সে খুশি হবে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আপনাকে পুনরায় কাজের জন্য সুপারিশ করবে।
এছাড়া আপনি চাইলে ক্লায়েন্টের সাথে কাজের পরবর্তী সময়েও যোগাযোগ রাখতে পারেন, যেমন বিভিন্ন হকিডেইজে উইশ করতে পারেন। এতে আপনাকে সে মনে রাখবে এবং পরবর্তীতে কাজের স্কোপ হলে আপনাকে সুপারিশ করতে পারে।শহিদুল আলম সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপরই কাজ করে থাকেন। দীর্ঘ এক যুগ যেখানে তিনি এই কাজ অনেক পরিশ্রম ও কম সুযোগ সুবিধায় করতেন ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে এসে তিনি এটা আগের চেয়ে আরো অনেক ভালোভাবে করতে পারছেন। আর ফ্রিল্যান্সিং তাকে তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একমাত্র সমাধান দিয়েছে যে কারণে বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং তার শুধু পেশা নয়, অনেকটা পরিবারের মতই। তার মতে ভবিষ্যতে যদি কখনো তিনি ফ্রিল্যান্সিং নাও করতে পারেন তবুও তিনি এই পেশাকে ভালোবাসবেন।