বৈশ্বিক ডিজিটাইজেশন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠছে এখন বাংলাদেশ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ‘ডিজিটাল ইকোনমাই রিপোর্ট-২০১৯ অনুযায়ী, বৈশ্বিক এ খাতে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন, যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে ১০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের আইটি খাতে ৩ লাখের বেশি পেশাজীবী কাজ করছে। এই কাজে প্রতিনিয়ত আইটি কর্মী ও পেশাজীবীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যেমন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হচ্ছে তেমনি নতুনদের ক্ষেত্রেও বাজারে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণের চাহিদা বেড়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে এই প্রশিক্ষণ অনলাইনে বিস্তার লাভ করেছে।
কেন বাড়ছে অনলাইনে তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ
শ্রমব্যয় কম থাকায় বিশ্বের আউটসোর্সিং বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি এখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে আইটি আউটসোর্সিং করছে। এতে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ফ্রিল্যান্সিং কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস। ফ্রিল্যান্সিং কাজের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, কর প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণ ও অনুসন্ধান ইঞ্জিন ওপটিমাইজেশনসহ অনেক কাজই রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক এসব কাজ উদীয়মান দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের বিপুল সুযোগ তৈরি করেছে, যা আগে ছিল না। ফলে তৈরি হয়েছে বিপুল কর্মসংস্থান।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ তরুণদের প্রতি ১০ জনের একজন বেকার। প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো হাজার হাজার শিক্ষার্থী মনের মতো চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে আছেন। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে খুব সহজেই আইটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার সুযোগ রয়েছে তাদের সামনে। আর শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য আইটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ছে। এতে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেদেরকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশীরভাগই সরাসরি ক্লাস নেবার পাশাপাশি অনলাইনেও সেবা দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে সুবিধাজনক সময়ে এবং অনেক কম খরচেই বিভিন্নরকম কোর্স করতে পারে যার মাধ্যমে তারা ফেসবুক মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, এসইও, অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের মতো নানা বিষয় দক্ষতা অর্জন করার সুযোগ রয়েছে।
ফ্রিল্যান্সিং এবং আইটি প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছে যারা
বাংলাদেশের তরুণরা বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং শেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশিক্ষক সেবা প্রতিষ্ঠান এবং কেউ কেউ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইটি খাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে অনলাইনে কোর্স করার সুবিধা দিচ্ছে ইনস্ট্রাক্টরি, উই মেক প্রো এবং বহুব্রীহিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, তরুণেরা এখন নতুন নতুন বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এর মধ্যে গ্রাফিকস, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, একাউন্টিং, পাওয়ার পয়েন্টের পাশাপাশি রয়েছে এক্সেলের বিভিন্ন কাজ। আর অফলাইনের চেয়ে বেশীরভাগ শিক্ষার্থী এসব প্রশিক্ষণ অনলাইনে করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। অনলাইনে করার সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহর থেকেও এসব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছেন, ফলে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে।
সরকারিভাবেও বাংলাদেশের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সীমিত আকারে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অনলাইনে চালাচ্ছে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া ইউটিউব বা গুগলে ব্লগ পড়েও শিক্ষার্থীরা নিজেদের দক্ষতা বাড়াচ্ছে।
অনলাইনে প্রশিক্ষণের পথে বাধা
প্রশিক্ষণের ক্লাসগুলো অনলাইন হয়ে যাওয়ায় এখনও বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বাংলাদেশের। সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ইন্টারনেট সেবার মান। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল্যও অনেক বেশি। তাছাড়া দেশের সব জায়গায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যায় না। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এটা অনেক বড় সমস্যা। এছাড়া ব্রডব্যান্ড সুবিধা থাকলেও অনেক সময় তা ধীরগতির হয়। মোবাইল ফোনের নেট ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যবহার করা বেশ ব্যয়বহুল।
যান্ত্রিক ত্রুটি অন্য একটি কারণ। শিক্ষার্থীরা আইটি খাতে জ্ঞান বাড়াতেই যেহেতু এসব প্রশিক্ষণে অংশ নেয় তাই বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এর আগে থেকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক গুলোতে দক্ষতা থাকে না। এ কারণে তাদের ডিভাইসগুলোতে অথবা মিটিং সফট্ওয়ারে কোন ধরনের সমস্যা হলে তা সমাধান করতে গিয়ে তারা হিমশিম খায়।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে টাকার সহজ লেনদেন ব্যবস্থা। সরাসরি দেখা না হওয়ায় আর্থিক লেনদেনের উপায়গুলো বলতে শুধু থাকে ব্যাংকিং মোবাইলে মানি ট্রান্সফার ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষানবিস এসব শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংক একাউন্ট থাকেনা এবং তারা মোবাইলে মানি ট্রানস্ফার করে থাকেন। মোবাইলে মানি ট্রান্সফারে সিস্টেম লস হয় অনেক বেশি এবং এতে অর্থ ব্যয় বাড়ে।
বাংলাদেশ অনলাইন তথ্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ এই সময়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই কর্মক্ষম। এই বিশাল যুব জনগোষ্ঠীকে মানব সম্পদে রূপান্তর করার মধ্যে একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক ভাবেও ফ্রিল্যান্সিং জগতের বাংলাদেশের একটি শক্ত অবস্থান আছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের যুব জনগোষ্ঠীর জন্য ফ্রিল্যান্সিং শেখা একটি আদর্শ সময়। যেখানে তরুণদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ বেকার। এই সবকিছু বিবেচনায় বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং এর একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ফ্রিল্যান্সার এবং আইটি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রশিক্ষণের নানান সুযোগ সুবিধা। অনলাইনে প্রশিক্ষণের এই ধারণা যদিও বেশ পুরনো কিন্ত এটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে ২০২০ সালে বৈশ্বিক করোনা মহামারীর পর। ২০২০ সালে যেখানে প্রায় সকল খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, আইটি খাতে পড়েছে এর ইতিবাচক প্রভাব। যার ফলে অনলাইনে আইটি প্রশিক্ষণ সম্ভবপর হয়েছে।