মিলন হাওলাদার একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। তিনি ছাত্র অবস্থাতেই অল্প সঞ্চয় আর বুকভরা সাহস নিয়ে ফিল্যান্সিং এর বাজারে প্রবেশ করেন। তিনি শুধু নিজেরই সফলতার সিঁড়িই উন্মোচিত করেন নি, কর্মসংস্থান করেছেন আরো ২৬ জন বেকার যুবকের। তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি ফ্রিল্যান্সিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে তিনি এই এজেন্সির স্বত্ত্বাধিকারী। তার এজেন্সি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইমেজ এডিটিং এবং প্রিন্ট ডিজাইন নিয়ে কাজ করছে।

মিলনের যাত্রার শুরু

মিলনের শুরুটা হয়েছিল ২০১২ সালে। তখন তিনি তার বন্ধুর জন্য কিছু ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে দিয়েছিলেন। সে সময়ে তিনি ভাবেন তিনি অন্যের জন্য কাজ করতে পারলে অবশ্যই নিজেই কাজগুলো করতে পারবেন। সেই আত্মবিশ্বাসকে সাথে নিয়ে তিনি একটি কম্পিউটার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার তখন একটি কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য ছিল না। মিলনের মায়ের একটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় ছিল স্থানীয় পোস্ট অফিসে। তখন মিলন হাওলাদার তার মাকে সঞ্চয়ের ঐ টাকা তাকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তার বাবা-মা কোন ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না। অনেক সময় নিয়ে বোঝানোর পরে শেষ পর্যন্ত তার মা তাকে টাকাটা দেওয়ার জন্য রাজি হন। এবং তখন মাত্র ২৬ হাজার টাকা দিয়ে মিলন একটি ছোট নোটবুক কেনেন। সেই সময়ে একটি হাই কনফিগারেশন কম্পিউটারকে কেনা তার জন্য অসম্ভব ছিল। সেই ছোট্ট নোটবুক ব্যাবহার করে যাত্রা শুরু করেই মিলন পারি দিয়েছেন অনেকটা পথ।

মিলন হাওলাদারের কাজ-কর্ম

মূলত ইমেজ এডিটিং এবং প্রিন্ট ডিজাইন নিয়ে কাজ করেন মিলন হাওলাদার। যদিও শুরুতে তিনি ওয়েব ওয়েব রিসার্চ এবং ডাটা এনট্রি নিয়ে কাজ করতেন কিন্তু এক বছরের মাথায় তিনি গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখেন। এরপর তিনি কাজ করেন এডোবি ফটোশপ এবং এডোবি ইলাস্ট্রেটর নিয়ে। বর্তমানে তিনি ও তার এজেন্সি গ্রাফিক্স ডিজাইনিং নিয়ে কাজ করছেন।

কেন ফ্রিল্যান্সিং

ছাত্রজীবন থেকেই মিলন ফ্রিল্যান্সিং এর সঙ্গে জড়িত। এই কাজের সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি এবং ক্যারিয়ারের উত্থান জড়িত। মিলন হাওলাদার বলেন, ‘আমি ফ্রিল্যান্সিং ভালোবাসি এবং তাই এ কাজটি আমার খুব পছন্দ। তাছাড়া এই কাজটি করার মাধ্যমে খুব সহজেই আমি অন্য জবের থেকে বেশি উপার্জন করতে পারি আর তাই আমি শুধু আবেগের দিক থেকেই না বাস্তবিক ভাবেও ফ্রিল্যান্সিংকে আমার প্রথম পছন্দ বলে মনে করি। ফ্রিল্যান্সিং করে যে পরিমাণ স্বাধীনতা পাওয়া যায়, অন্য কোন কাজে এমনটা বিরল’

প্রতিকূল পথ কিন্তু লক্ষ্য স্থির

মিলন বলেন, ‘যখন আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করি তখন কাজ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। এখন যেমন কঠিন তখনো তেমন কঠিন ছিলো। আমার কম্পিউটার কেনার এক মাস পর একদিন আমার বড় ভাই আমাকে বলেন তুমি অনেকগুলো টাকা নষ্ট করেছো অনেক গুলো দিনো অতিক্রম করেছো! এখন পর্যন্ত ফলাফল শুন্য। তোমার ইনকাম কই? আমার তখন কিছুই বলার ছিল না। সত্যিই ফলাফল ছিল শূন্য। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে একদিন সময় বদলাবে। এবং তার ঠিক একমাস পরেই আমি পাঁচ ডলারের একটি ছোট কাজ পাই। আমার কাজে ক্লায়েন্ট খুব খুশি হয়েছিলেন এবং তিনি আমাকে আরো একটি কাজ দেন দশ ডলারের। এভাবে আস্তে আস্তে আমার ক্লাইন্ট এর সংখ্যা বেড়ে যায় আর আমাকে কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

মিলনের অনুপ্রেরণার উৎস

মিলনের বন্ধু যে, তাকে কাজ দিয়েছিল শুরুতে সেই ছিল মিলনের অনুপ্রেরণা। প্রথমে ফ্যামিলি থেকে সাপোর্ট না পেলেও কিছুদিন পরে সবাই সাপোর্ট করেছেন এখনো করছেন।  তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং কাজের গতিশীলতা ও নিজের স্বাধীনতার ধারণা তাকে এই কাজে আগ্রহী করেছে। এছাড়াও ফ্রিল্যান্সিং এ উপার্জনের পরিমাণ তাকে এই কাজে উৎসাহিত করেছে।

মার্কেটপ্লেস ও কাজের এলাকা

মিলন তার এজেন্সি কে সাথে নিয়ে বর্তমানে আপওয়ার্ক এবং ফাইবার ওয়েবসাইটে গ্রাফিক্স ডিজাইনিং নিয়ে কাজ করেন। শুরুতে তিনি ওয়েব ওয়েব রিসার্চ, ডাটা এন্ট্রির কাজ করতেন। পরে তার কাজের ধরণ বদলে ফেলেন। বর্তমানে প্রধানত তিনি ইমেজ এডিটিং ও প্রিন্ট গ্রাফিক্স নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

ফ্রিল্যান্সিং ছাড়া অন্য কাজ

মিলন জানান ফ্রিল্যান্সিং এর বাইরে অন্য কোন কাজের অভিজ্ঞতা তার নেই। তিনি কখনোই দেশের চাকরির বাজারে কারো ধরণা দেন নি। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পড়ার সময়েই তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন এবং এই কারণে তার কখনোই চাকরিতে আবেদন করার প্রয়োজন পড়েনি।

বদলাতে থাকা বাজারের সাথে খাপ খাওয়ানো

আমাদের সবাইকেই সময়ের সাথে সাথে নিজেকে বদলাতে হয় এবং ফ্রিল্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রি খুব দ্রুত পাল্টায়, একই হারে পালটায় বাজার চাহিদা। আর তাই বাজারের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ঝুঁকি ও আছে। মিলন জানান তিনি এখন বাজার চাহিদার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য নন বলেই মনে করছেন। তিনি মনে করেন তার যেই সকল দক্ষতা থাকার দরকার তার ঘাটতি আছে। তিনি চেষ্টা করছেন এবং আশা করেন খুব শীঘ্রই তিনি এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

 

মিলন হাওলাদার

ফ্রিল্যান্সিং এর শিক্ষা

ফ্রিল্যান্সিং একটি প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা প্রতিযোগিতার বাজার। বাস্তব জীবনে এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। মিলন বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং আমাকে শিখিয়েছে যে আমার স্বপ্নের কোনো সীমা নেই এবং আমি যদি যথেষ্ট পরিশ্রম করি তাহলে আমার সব স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে আমার যোগাযোগ দক্ষতা বেড়েছে বহুগুণ। ফ্রিল্যান্সিং আমাকে অন্যকে সাহায্য করতে, অন্যকে স্বাবলম্বী করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

ক্লাইন্টকে খুশি রাখার পরামর্শ

ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতিযোগিতার বাজারে ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে মিলন হাওলাদার প্রথমত যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ক্লায়েন্টের বিশ্বাস অর্জন করতে আপনার যোগাযোগ দক্ষতা হতে হবে সর্বোচ্চ মানের।
দ্বিতীয়তঃ তিনি প্রজেক্ট সাবমিশন এর ক্ষেত্রে সতর্ক থেকে বারবার ভুল যাচাই করার পরামর্শ দেন।

তৃতীয়তঃ তিনি বলেন, ‘ডেডলাইন এর আগে কাজ শেষ করতে পারা আপনার গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তিকে ক্লায়েন্টের কাছে আরও উজ্জ্বল করবে। অনেকে সময়ে নতুনরা এই বিষয়ে সচেতন থাকেন না কিন্তু সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে যারা সময়ের মূল্য বুঝেন শুধু তারাই ক্যারিয়ারে উন্নতি করেন।

নতুনদের জন্য পরামর্শ

ফ্রিল্যান্সিং বাজারে যারা নতুন যুক্ত হন তাদের ধৈর্য খুব কম থাকে। এটা কাজ শেখার ক্ষেত্রে এবং কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে দুই ক্ষেত্রেই সত্য। তিনি বলেন “আমি অনেককে দেখেছি ১ মাস বা ৩ মাস বা ৬ মাস পরেই হাল ছেড়ে দেন। আসলে কাজ না পেলে খুজে বের করতে হবে আপনার দুর্বলতা কোথায়।“ মিলন নতুনদেরকে কাজের দক্ষতা বাড়াতে অনুরোধ করেন। কোন কাজে দক্ষতা থাকলে এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকলে ভাগ্য যতই খারাপ থাকুক না কেন সাফল্য আসবেই। সাফল্য আসতে দেরি হতে পারে কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া চলবে না।

ভবিষ্যৎ এবং মিলনের লক্ষ্য

মিলন জানান তার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য তার পরিবার এবং সহকর্মীদেরকে খুশি করা। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারকে আমি সুখী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি এবং আমি যদি আমার সহকর্মীদেরও সুখী রাখতে পারি তাহলে তারাও তাদের পরিবারগুলোকে সুখী করতে পারবেন। আমি আশা করি আমি ও আমার সহকর্মীরা একসাথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো, সেই সক্ষমতা আমাদের আছে। আমি আশা করি আমার এই এজেন্সি দিনে দিনে বড় হবে এবং আমি আরো অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব।’ মিলন বলেন “আমার একটা স্বপ্ন ছিলো, যে আমার প্রতিষ্ঠানে কিছু কর্মী থাকবে প্রতিমাসে নিজ হাতে তাদের বেতন দিব। কিছুটা হলেও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।“ আরো অনেকদূর যেতে চান মিলন।

নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে ধৈর্য্য ধরে কাজ করে গেলে যে সাফল্য পাওয়া যায় তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ মিলন হাওলাদার। অনেক ছোট পর্যায় থেকে তিনি ধীরে ধীরে আজকের এই স্থানে এসেছেন। কিন্তু তার মধ্যে অহংকারের ছিটেফোটাও নেই। নিরহংকার এই মানুষটির কাছ থেকে এখনকার ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।