সফল ফ্রিল্যান্সার মাহফুজ মোঃ লুৎফুল ইয়াজদানী। ফ্রিল্যান্সিং জগতে তিনি গত পাঁচ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু নিজে অর্থ উপার্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদানই রাখছেন না, কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই সাহায্য করেছেন এবং কাজ শিখিয়েছেন নতুন ফ্রিল্যান্সারদের। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সফলতার সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং জগতের অন্যতম শীর্ষ স্থান দখল করেছেন।
পথচলার শুরু
মাহফুজ মোহাম্মদ তার যাত্রা শুরু করেন ২০১৪ সালের শেষ দিকে। তখন তার কোনরকম চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। ব্যবসার ইচ্ছা নিয়ে তিনি ২০১০ সালে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন। এছাড়া ফার্নিচার ব্যবসাও শুরু করেন। কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি। তারপর তিনি ভাবতে শুরু করেন জীবনে কী করবেন এবং ফ্রিল্যান্সিং এর বিষয়টি তার ভাবনায় আসে। কম্পিউটার বিষয়ে আগে থেকেই তার জানাশোনা ছিল। মাহফুজ বলেন, ‘সে সময়ে অনেক কোচিং সেন্টার ছিল ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য। কিন্তু আমি ফেসবুকে আমিনুর রহমানকে পেয়েছিলাম। তিনি এখানকার অন্যতম সুপরিচিত একজন ফ্রিল্যান্সার। তিনি তার বাসাতেই ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য একটি ট্রেনিং সেন্টার চালু করেছিলেন। সেখানে আমি তার কাছে দুই মাস কাজ শিখি। এরপর আমি মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরক নামে একজনের সন্ধান পাই মেহেরপুরে। তিনিও ফ্রিল্যান্সিং শেখান এবং আমি তার কাছে আরও পাঁচ মাস কাজ শিখি। এবং সেখান থেকেই আমার জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে। মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরক কাছে আমি অনেক কিছু শিখি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ইল্যান্স এবং ওডেস্ক এ কাজ শুরু করি। ওডেস্কে আমি খুব বেশি সাড়া পাইনি কিন্তু ইল্যান্সে আমি বেশ সাড়া পাচ্ছিলাম ক্রেতাদের কাছ থেকে। তার কয়েক বছর পরে ইল্যান্স এবং ওডেস্ক একসাথে মিলে গিয়ে আপওয়ার্ক ডট কম হয়ে যায়। এদিকে আগে থেকেই আমার পরিচিত কিছু ক্লায়েন্ট ছিলেন যাদের সাথে আমার বেশ ভাল সুসম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে তাদের নিয়েই আমি আপওয়ার্কে কাজ করতে থাকি।
মাহফুজ মুহাম্মদ এর কাজ/প্রফেশনাল জীবনে মূলত যে ধরণের কাজ করে থাকেনঃ
ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েব ডেভলপমেন্ট দিয়ে শুরু হয় মাহফুজ মুহাম্মদ এর কাজ। এরপর ওয়ার্ডপ্রেস কাস্টমাইজেশন, ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ওয়ার্ডপ্রেস টিম ম্যানেজমেন্ট, ওয়ার্ডপ্রেসে ডিজাইন কনভার্শন, বেসিক এসইউভি, ওয়েব সিকিউরিটি এবং অন্যান্য অনেক কাজ করেন মাহফুজ। তিনি এই ক্ষেত্রগুলোতে বিশেষভাবে পারদর্শী।
এই খাতে কাজ করতে যে দক্ষতার প্রয়োজন
এখানে কাজ করার মূল বিষয়টিই কোডিং। মাহফুজ বলেন, ‘ইদানিং ফ্রিল্যান্সাররা ভিসুয়াল কমপোসার দিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটা দিয়ে সাধারণ কিছু কাজ বাদে জটিল কাজ করা যায় না তাই ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর ক্ষেত্রে কোডিং জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ মাহফুজ বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন এইচটিএমএল, সিএসএস, পিএইচপি, জাভাস্ক্রিপ্ট সমূহ কোডিং এর বিষয়ে। তার মতে যত বেশি কোডিং জানা থাকবে ততই ভালো হবে কাজের মান।
কেন ফ্রিল্যান্সিং
আমরা মাহফুজের কাছে জানতে চাই কেন তিনি ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মাহফুজ বলেন, ‘যেহেতু চাকরি করার কোন ধরনের ইচ্ছেই আমার ছিলনা এবং আমি কিছুটা অগোছালো মানুষ তাই আমি ফ্রিল্যান্সিং বেছে নিয়েছি। আমি স্বাধীনচেতা এবং অন্যের কর্তৃত্ব আমি পছন্দ করিনা। ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে আমি শুরুতে ভাবি নি আমি এতোটা সফলতা পাব। ভেবেছিলাম, মোটামুটি খেয়ে পরে চলতে পারব।
মাহফুজ আরো বলেন, ‘কিন্তু মাঝেমাঝে ফ্রিল্যান্সিং চাকরির চেয়েও কঠিন। কিন্তু এতসব কঠিন কাজ করে ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে টাকা আয়ের সুযোগ চাকরির চাইতে অনেক বেশি।’
শুরুটা সহজ ছিল না
আমিনুর রহমানের কাছে মাহফুজ কাজ শিখেন দুই মাস এবং মেহেরপুরে মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরকর কাছে আরও পাঁচ মাস। তারা মাহফুজকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। মাহফুজও তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। শুরুর সেই দিনগুলোতে মাহফুজকে টানা কাজ শিখতে হতো। নির্ঘুম কাটতো প্রায় রাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাহফুজ নিজেকে অন্যতম ভাগ্যবান বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ শুরুতে আমাকে দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়েছে কিন্তু তবুও আমার ধারণা, আমি অন্য অনেকের চাইতে অনেক ভাগ্যবান। কারণ খুব কম সময়ের মধ্যে আমি উপার্জন করতে শুরু করেছি এবং আমার ক্যারিয়ারে এগিয়ে গেছি।’
ফ্রিল্যান্সার হবার অনুপ্রেরণা
কেউ কেউ মাহফুজকে ফ্রিল্যান্সার হওয়ার অনুপ্রেরণা দিলেও মাহফুজ বলেন জলজ্যান্ত মানুষের চাইতে টাকা উপার্জনের বিষয়টিই তার জন্য বড় অনুপ্রেরণা ছিল। তিনি বলেন, ‘আমি ফ্রিল্যান্সার হলে টাকায় না, ডলারে আয় করব। আর এক ডলার সমান আশি টাকারও বেশি! এই বিষয়টি আমাকে সবচাইতে বেশি প্রেরণা দিয়েছে। এছাড়া অবশ্যই জনাব আমিনুর রহমান, মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হীরক এবং রাসেল আহমেদ আমাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছেন। আমিনুর রহমান এবং মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরক ছিলেন আমার শিক্ষক এবং আমি রাসেল আহমেদ এর টিউটোরিয়াল ভিডিও গুলো দেখতাম। তারা তিনজনই আমার সাফল্যের পথে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
মাহফুজের কাজ ও মার্কেটপ্লেস
মাহফুজ একাধারে কাজ করেন ওডেস্ক, ফ্রিল্যান্সার ডট কম, ফিভার এবং ইল্যান্সে। শুরুর দিকে তিনি ইল্যান্সে সাফল্য পান এবং এরপরে ওডেস্কে। তারপর এই দুইটি ওয়েবসাইট মিলে গিয়ে হয়ে যায় আপওয়ার্ক ডটকম। ফিভার ডট কমে তার প্রোফাইল রয়েছে কিন্তু আপওয়ার্কে কাজের চাপ বেশী থাকায় তিনি বর্তমানে আপওয়ার্ক নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
ক্লায়েন্টকে খুশি রাখার তিনটি উপায়
প্রতিটা মানুষই আলাদা এবং প্রত্যেকে খুশি করার পদ্ধতিও আলাদা তাই বিষয়টা সহজ না। ক্লাইন্ট হতে পারে খুব বুদ্ধিমান সাধারণ বা কম বুদ্ধিমান। ক্লায়েন্ট অনেক সময় সহযোগিতার মনোভাবের অধিকারী হন, কখনো হন না। প্রতিটা ক্লায়েন্টই আলাদা। মাহফুজ বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি বৈশ্বিক বাজার তাই ক্লায়েন্ট কখনো মধ্যরাতে, কখনো ভোরে, কখনো সন্ধ্যায় আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তাই আপনাকে দ্রুত ক্লাইন্টকে সাড়া দেবার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ কারো পক্ষেই সবকিছু জানা সম্ভব না তাই আপনাকে অবশ্যই আপনার কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যদেরকে চিনতে হবে। অনেক সময় একটি প্রজেক্ট একা সামলানো যায় না। তখন অন্যদের সাহায্য নিয়ে কাজটি করা সম্ভব।
তৃতীয়তঃ আপনাকে বুঝতে হবে ক্লায়েন্ট কী চায় এবং তাদেরকে সময় দিতে হবে। তাদেরকে খুশি করতে পারলেই আপনি সফল।
নতুনদের জন্য মাহফুজের পরামর্শ
ইতোমধ্যে মাহফুজ অনেককে বিনামূল্যে ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়েছেন। কিন্তু নতুনদের বেশিরভাগই মনে করেন যে তারা একটি কম্পিউটার কিনে কাজ শুরু করে দিলেই প্রথম দিন থেকেই অনেক উপার্জন করতে শুরু করবেন। আর এই ধারণাই তাদের সবচাইতে বড় ভুল। মাহফুজ বলেন আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। বাজার এবং ক্লায়েন্টের চাহিদা বুঝতে হবে। কোন তাড়াহুড়া করা যাবে না।
দ্বিতীয়তঃ কাজের সঠিক মূল্য নির্ধারণ খুব জরুরী। ভাগ্যও বড় একটা বিষয় কিন্তু আপনি যদি ক্লায়েন্টকে বোঝাতে পারেন এবং তার বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন তাহলে অবশ্যই তারা আপনাকে তাদের প্রজেক্টে নেবে।
মাহফুজ জোর দিয়ে বলেন যে যদি কেউ চেষ্টা চালিয়ে যায় তাহলে তার ভাগ্য যতই খারাপ হোক একদিন না একদিন তার সাফল্য আসবেই। মাহফুজ বিশ্বাস করেন দক্ষতাই এই বিষয়ের মূল চাবিকাঠি একজন দক্ষ ব্যক্তি কখনোই বেকার থাকেন না। আর মাহফুজ নিজেকে বিশ্বাস করেন এবং আগামীতে এই বিশ্বাসকে সাথে নিয়ে তিনি তার কর্ম ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান।