আশরাফুল ইসলাম একজন তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি একজন সফল ফ্রিল্যান্সার এবং মাত্র কয়েক বছরেই তিনি এখন ফ্রিল্যান্সিং জগতে সাফল্যের এক অনন্য উদাহরণ।
তার ক্যারিয়ারের শুরু
আশরাফুল ২০১৪ সালে কলেজে পড়তেন। সেসময় তিনি একটি কম্পিউটার কেনেন এবং কম্পিউটারের বিভিন্ন দক্ষতা রপ্ত করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই, তিনি বেসিক ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতা অর্জন করে নেন এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে যোগ দেন। আর ক’দিনের মধ্যেই তিনি বিশ্বব্যাপী ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে সাড়া পেতে শুরু করেন।
আশরাফুল ইসলামের কাজ
আশরাফুল ইসলাম এস.ই.ও (সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন) কাজে বিশেষ পারদর্শী। এস.ই.ও খাতেই তিনি বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি কানাডার সংস্থা ‘আনলিমিটেড এক্সপ্লোশন’ এর জন্য কাজ করছেন। তিনি আপওয়ার্ক বা ফাইভার ডটকমের মতো অনলাইন বাজারেও কাজ করেন।
কেন ফ্রিল্যান্সিং
আশরাফুল ইসলাম হরেক রকম মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসেন। বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে তিনি পছন্দ করেন। এই নানান রকম মানুষের বৈচিত্র্য তাকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেও পছন্দ করেন। প্রতিবার যখন একটি নতুন প্রজেক্ট শুরু হয় সেই প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করা আর ক্লায়েন্টকে খুশি করাই তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সত্যি বলতে ২০১৪ এর আগে আমার ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না তবে ফ্রিল্যান্সার হিসাবে আমার যাত্রা শুরুর পরে এটি এখন আমার জন্য ভালোবাসার এক হয়ে উঠেছে। একদিকে চ্যালেঞ্জ এর আনন্দ আর অন্যদিকে নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা মাথায় রেখে পেশাগত ক্ষেত্রে আমি বলব ফ্রিল্যান্সিংই আমার প্রথম পছন্দ’।
শুরুটা সহজ ছিল না
লড়াই না করে কেউ সফল হতে পারে না। আর শুধু ফ্রিল্যান্সিংই না, সব কাজের ক্ষেত্রেই শুরুটা কঠিন। আশরাফুল ইসলামের শুরুটাও সহজ ছিল না। তার শুরুর গল্পটাও অন্যদের মতোই সংগ্রামের, কঠিন পরিশ্রমের।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আশরাফুল। তার ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার কেনার কিন্তু তখন তার বাবা কিনে দিতে পারছিলেন না। তখন তার চাচা তাকে পনের হাজার টাকা দেন। বাবা দেন আরো দশ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনি মাঝারি সক্ষমতার একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কেনেন। এরপরই শুরু হয় কম্পিউটারে বিভিন্ন দক্ষতা বিকাশের পালা। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কাজ শেখার পরে যখন তিনি অনলাইন বাজারে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেন, শুরুতেই তাকে পড়তে হয় সমস্যায়। বড় সমস্যা ছিল ইংরেজি ভাষা দক্ষতা। শুরুর সেই দিনগুলিতে তার ইংরেজি খুব খারাপ ছিল। একদিন এক ক্লায়েন্ট তার সাথে যোগাযোগ করে মেসেজ পাঠান। কিন্তু উত্তর দেওয়ার বদলে আশরাফুল ইসলাম খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তিনি মেসেজটি কপি করে গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে অনুবাদ করে মেসেজটি বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।
আশরাফুল ইসলাম জানান, ‘বাজারে কাজ কম আর প্রতিযোগিতা ছিল বেশি। একেকটা চাকরির জন্য অনেক ফ্রিল্যান্সার আবেদন করতো। এই প্রতিযোগিতা দেখে আমি তখন ভিন্ন কিছু ভাবলাম। আমি রাত ১১ টা বা ১২ টার মধ্যেই ঘুমিয়ে যেতাম আর রাত আড়াইটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠতাম। এই সময় গভীর রাতে ফ্রিল্যান্সাররা খুব কমই অনলাইনে থাকতেন। এই ফাঁকা সময়ে আমি আরো বেশি ক্লায়েন্টের সাড়া পেতাম’। আশরাফুল সেসময় দিনে সর্বোচ্চ ৪ বা ৫ ঘন্টা ঘুমাতে পারতেন কারণ তাকে সকাল ৮ টায় ক্লাসে যোগ দিতে হতো। কলেজে নতুন ভর্তি হওয়ায় ক্লাসে অংশ নেওয়া তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আশরাফুল বলেন, ‘আর অবশ্যই আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম নাহলে মার্কেটে সাড়া পেতাম না’।
আশরাফুলের অনুপ্রেরণা
কাজে তাকে অণুপ্রেরণা কে দিয়েছেন জিজ্ঞেস করতেই আশরাফুল তার শুভাকাঙ্খী হাসানের কথা বলেন। আশরাফুল আর হাসান তাদের তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একই সাথে। হাসান তাকে সবসময় বলতেন চেষ্টা চালিয়ে যেতে আর অবশ্যই সফলতা একদিন আসবেই। তার ক্যারিয়ারের শুরুতে আশরাফুলকে অনেক সাহায্য করেছিলেন হাসান। এই স্মৃতি মনে রেখেই আশরাফুল সবসময়ই হাসানকে অণুপ্রেরণা বলে মনে করেন।
যেখানে কাজ করেন আশরাফুল
বর্তমানে আশরাফুল ইসলাম আপওয়ার্ক ডট কম এবং ফাইভার ডট কম-এ কাজ করছেন। তিনি এই বছরই সম্প্রতি ফাইভারে যোগ দিয়েছেন। এবং ইতোমধ্যে তিনি ফাইভারের ক্লায়েন্টদের কাছ থেকেও অবিশ্বাস্য সাড়া পাচ্ছেন। এটি তার জন্য বেশ অবাক করা বিষয় ছিল।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে আশরাফুলের সবচেয়ে বড় কাজ
আশরাফুল বলেন, ‘আমি যখন পেশাদারিত্বের সাথে বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছিলাম তখন সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল ছোট ছোট নানান কাজ। হঠাৎ ২০১৫ এর মাঝামাঝি সময়ে ফ্রিল্যান্সার হিসাবে একটি বড় চমক পাই। আমি ৫০০০ ডলার মূল্যের একটি খুব বড় প্রকল্প হাতে পাই। সেই প্রকল্প নিয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম। আমার নিজের উপার্জন থেকে সেদিন আমি একটি ল্যাপটপ কিনেছিলাম এবং এটি ছিল আমার জন্য খুব গর্বের মুহূর্ত। এবং সেই সময় থেকে, আমি আমার ক্যারিয়ারে কখনোই বসে ছিলাম না’।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা হালনাগাদ
সময়ের সাথে সাথে নিজের দক্ষতা শানিয়ে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্লায়েন্টরা কোনও মান্ধাতা আমলের ফ্রিল্যান্সারের উপর তাদের অর্থ ব্যয় করবে না। এবং এটি মাথায় রেখেই আশরাফুল ক্লায়েন্টের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সবসময় নিজেকে আপডেট রাখে। সমস্যার সমাধান এবং হালনাগাদ তথ্য খুঁজতে তিনি গুগলের উপর ভরসা করেন সবচেয়ে বেশি। তার মতে মানুষ ভার্চুয়ালি যত সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেগুলির ৯০% গুগলের মাধ্যমেই সমাধান করা যায়। নিজেকে আপডেট রাখার জন্য তিনি সবসময় ইউটিউব এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্লগ পড়েন এবং ভিডিও দেখেন। তিনি বলেন, ‘একদিন একজন ক্লায়েন্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি গুগল এনালিটিক্স (Google Analytics) সেটাপ করতে পারি কিনা। এই সময় আমি কাজে নতুন ছিলাম এবং গুগল এনালিটিক্স (Google Analytics) কীভাবে সেটআপ করতে হয় তা আমি জানতাম না। আমি তখন ইউটিউব এবং গুগলে এই নিয়ে খোঁজাখুজি করি। তারপরে এটি শিখে আমি এমএল আইডির কাজটা করে দিই। আমার ক্লায়েন্ট সেই কাজ নিয়ে খুব খুশি হয়েছিল ‘
ফ্রিল্যান্সার হওয়া সম্পর্কে সবচেয়ে খারাপ দিক
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘একদমই না। খারাপ কোন দিক মনে আসে না। প্রতিটি পেশারই খারাপ আর ভাল এর পক্ষে যুক্তি আছে তবে সত্যিই আমি ফ্রিল্যান্সার হওয়ার বিপক্ষে কোন যুক্তি খুঁজে পাই না। আমি ফ্রিল্যান্সার হতে পেরে গর্বিত। এবং আমি আমার নিজের কাজটি করতে পছন্দ করি।
ক্লায়েন্টকে খুশি রাখার উপায়
‘ক্লায়েন্টের সন্তুষ্টি এবং ক্লায়েন্ট পরিচালনা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একটি বড় সমস্যা। আমার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাকে আপনাদের তিনটি পরামর্শ দেই।
এক নম্বর, সবসময় আপনার ক্লায়েন্টের সাথে সৎ থাকুন।
দ্বিতীয়ত, তাদেরকে সবচেয়ে ভালো সার্ভিসটি দিন এবং যে সেবা তারা চায়ও নি তাদের সেই সেবা দিয়ে খুশি করে ফেলুন।
এবং সবশেষ হলো সবসময় ক্লায়েন্টের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। কখনও কখনও, আপনি খারাপ আচরণের ক্লায়েন্ট পেতে পারেন তবে আপনাকে সেগুলি বিনীত উপায়ে মিটমাট করতে হবে।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
নতুনদের কাজের ক্ষেত্রে আশরাফুল সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন কাজের দক্ষতা অর্জনে। অনেকেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছাড়াই এই সেক্টরে চলে আসে। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং নতুনদের ভাবনার মতো সহজ নয়। এটি একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বাজার। আশরাফুল পরামর্শ দেন যে, যথাযথ দক্ষতা ছাড়া কেউ এখানে টিকতে পারবে না। তিনি জানান ‘আপনাকে সবসময় মানসম্পন্ন কাজ সরবরাহ করতে হবে আর টাকা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। আপনার যদি কাজের দক্ষতা থাকে তবে আপনি অবশ্যই সফল হবেন। আশা কখনোই হারাবেন না। আপনি যদি পরিশ্রম করেন তবে আপনি সফল হবেন ইনশাল্লাহ’।
আশরাফুল ইসলামের গতিশীলতা আর প্রতিনয়ত বদলাতে থাকা বাজারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাই তাকে একজন সফল ফ্রিল্যান্সারে পরিণত করেছে। দক্ষতা অর্জন আর নিজের কাজে পারদর্শীতা অর্জনের পর থেকে আশরাফুলকে আর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। মূলত তার ইচ্ছাশক্তি এবং দক্ষতাই তাকে আজকের আশরাফুল ইসলামে পরিণত করেছে।