লাখ টাকার নিশ্চিত কর্পোরেট একাউন্টেন্ট জব না অপরিচিত ট্র্যাকের অনিশ্চিত ফ্রিল্যান্স ক্যারিয়ার? কম্পিটেটিভ পেশাদার জগতে যেখানে পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা শেষে জুতসই চাকরি জোটানো বেশ চ্যালেঞ্জিং, তখন সন্দীপন পাল এসিসিএ কমপ্লিট করে ফ্রিল্যান্সিং করছেন ফ্রিল্যান্স চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হয়ে! দেশে বসেই সামলাচ্ছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির ফিনান্সিয়াল দিক। শুরুতে ছোটখাট ডাটা এন্ট্রি আর বুককিপিং এর কাজ করতেন। ক্রমাগত নিজের দক্ষতা উন্নয়ন আর কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন নিজের একাউন্টিং ফার্ম। বর্তমানে দেশে বসেই সামলাচ্ছেন বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হিসাবপত্র। সাধারন ফ্রিল্যান্সার থেকে আন্তর্জাতিকমানের চাটার্ড একাউন্টেন্ট হওয়ার এই সাফল্যগাঁথা নিয়ে সন্দীপন পালের ভাবনা;
কোন অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও এতদূর কিভাবে আগালেন?
“আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি ২০১১ সালে আপওয়ার্কের মাধ্যমে, বয়স মাত্র ২০ বছর, তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা কোনটাই ছিলোনা তখন। এর মধ্যে নিজের এসিসিএর (ACCA) পড়াশোনাও চলমান। এ অবস্থায় প্রথমদিকে প্রায় ৭০ ডলার উপার্জনের পর বুঝতে পারলাম এ সেক্টরে ভাল করতে হলে আসলে দক্ষতার বিকল্প নাই। তাই সিদ্ধান্ত নিই নিজের পড়াশোনা শেষ করে আরো ভালমত স্কিল ডেভেলপিংএ মনোযোগ দেয়ার। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে পড়াশোনা শেষ করে আবার কাজ শুরু করি,ততদিনে বুককিপিং সহ একাউন্টিং এর অন্যান্য বিষয়ে নিয়মিত ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ করেছি। স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য প্রায় ২ বছর ছিলাম একটা লোকাল সিপিএ ফার্মে। ফলে অভিজ্ঞতা নিয়েও বেশ কনফিডেণ্ট ছিলাম, সবমিলিয়ে সাকসেস নিয়ে এবার আর ভাবতে হয়নি 🙂
একাউন্তিং নিয়ে আপনি মূলত কোন ধরনের কাজ করেন/সার্ভিস দিয়ে থাকেন?
“ আমি এসিসিএ (ACCA) কমপ্লিট করে পেশাদার সার্টিফাইড চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। বর্তমানে আমার এজেন্সির সাহায্য প্রফেশনাল বুককিপিং, ফিনানসিয়াল অ্যানালাইসিস, সিএফও সংক্রান্ত সার্ভিস দিয়ে থাকি। এর জন্য আছে দক্ষ একাউন্টেণ্ট, ফিনান্সিয়াল অ্যানালিস্ট নিয়ে আমার ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস টিম। ফলে ই-পেমেন্ট প্রসেসিং বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সহ ছোট, বড় মোটামুটি সব ধরণের প্রতিষ্ঠানকে মাল্টিকোর ফিনান্সিয়াল সার্ভিস দিতে আমরা সক্ষম।”
এই ফিল্ডে কাজ করতে চাইলে কেমন দক্ষতা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
“ আমি মনে করি ফিনান্সিয়াল সেক্টর পুরোপুরি নলেজ আর স্কিল নির্ভর। দক্ষ একাউন্টিং সার্ভিস দিতে হলে হিসাববিজ্ঞান বা ফাইনেন্স নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি থাকা প্রয়োজন। টেকনিক্যাল নলেজ অবশ্যই ভাল হতে হবে। বিশেষ করে কুইকবুক,ক্সেরো, জোহোবুক, ওয়েবএপ ইত্যাদি একাউন্টিং সফটওয়্যার কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ফাইনেন্স এপ্স ইনটিগ্রেড করা, ক্লাউডে কিভাবে কাজ করতে হয় ইত্যাদি স্কিল থাকা প্রয়োজন। আবার জব বা নিজের ব্যবসা পরিচালনার হ্যান্ডস-অন- এক্সপিরিয়েন্স থাকলে তা বেশ কাজে দেয়।
ফাইনেন্স কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং, আর ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট বলে ব্যাপারটা আরো জটিল । এর জন্য সবসময় মানি মার্কেট নিয়ে বিশদ পড়াশুনা, মনেটারি বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ফ্রিল্যান্সিং এ আগ্রহী হলেন কেন?
“নিজে কিছু করার আগ্রহ থেকে! মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করানো। কিন্তু ইচ্ছা, আগ্রহ থাকলেও আর্থিক প্রতিকুলতা আর পারিপার্শ্বিক কারণে ব্যবসা করাটা সহজ ছিলোনা। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় এসে সমস্যাগুলো কাটিয়ে এখন দুটো কোম্পানির ফাউন্ডার!
ফ্রিল্যান্সার থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার এই যাত্রাকে কিভাবে দেখেন?
“ যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল মনে করি। অর্জনের পাল্লা এখন ভারি হলেও শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
প্রথমদিকে যখন কাজ করতাম পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কারোরই ক্লাউড, অনলাইন একাউন্টিং সফটওয়্যার সহ অন্যান্য আইটি বিষয়ে ভাল নলেজ ছিলোনা।শেখার জন্য শুরু থেকেই আমি সেলফ-লারনিংএ অভ্যস্ত। প্রচুর ভুল করেছি কিন্তু হাল ছাড়িনি কখনো। কন্টিনিউয়াস এই প্রসেস ফলো করে বিভিন্ন একাউন্টিং টুলস সহ ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, একাউন্টিং ম্যানেজমেন্ট, বুককিপিং, ফিনান্সিয়াল এনালাইসিস এর মত দুরূহ বিষয়গুলো আয়ত্তে এনেছি। নিজের এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছি ৪০+ মেম্বারের চমৎকার টিম।
তবে ভাল লাগে যখন এসব স্ট্রাগলের পর যা যা করতে পেরেছি তা আমার নিজেকেই অনুপ্রেরনা দেয় সামনে আরো বেটার কিছু করার।”
ফ্রিল্যান্সিং এ কেউ কি আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?
হ্যাঁ, আমার মা। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি আমাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল হতে অনুপ্রাণিত করেন। আমাকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে বহুবার আর্থিক সমস্যা সহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এরপরেও সবসময় চেষ্টা করেছেন আমার পাশে থাকার। আমার মাকে নিয়ে আমি গর্বিত এবং আমার সাফল্যর পেছনে মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি।
বর্তমানে কোন কোন মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন?
আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছি ওডেস্ক মার্কেটপ্লেসে যা এখন আপওয়ার্ক নামে পরিচিত। এখনো আপওয়ার্কে প্রচুর কন্ট্রাক্ট পাই। তাছাড়া গোল্যান্স, ফাইভার মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি ডিরেক্ট ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও কাজ করে থাকি।
ফ্রিল্যান্স মানি মার্কেট নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছেন, আপনার মতে ক্লায়েন্ট স্যাটিসফেকশনের সেরা ৩টি টিপস কি কি?
– কম-বেশি যাই করে থাকুন না কেন, নিয়মিত কাজের অগ্রগতি নিয়ে আপডেট দেয়া।
– কাজের গুণগত মান নিশ্চিতে প্রাসঙ্গিক ইনফরমেশন চাইতে ভুলবেননা, চেষ্টা করবেন ক্লায়েন্টের প্রত্যাশার চেয়ে ভাল কিছু দেয়ার।
– সবশেষে নিজের কাজে সৎ থাকুন, ক্লায়েন্টের কাজকে স্রেফ দায়িত্ব মনে না করে কিভাবে বেস্ট সার্ভিস দেয়া যায় তার পরিকল্পনা করুন।
নতুনদের জন্য কোন টিপস
- একাউন্টিং বা বিজনেস কনসালটিং নিয়ে যদি উপযুক্ত পড়াশোনা, দক্ষতা না থাকে তাহলে এ সেক্টরে না আসাই উচিত। প্রথমে নিশ্চিত করুন আপনি কাজের যোগ্য। দক্ষতা থাকলে যেমন কাজের অভাব হবেনা তেমনি গোঁজামিল দিয়ে কাজ করতে চাইলে এই সেক্টর আপনার জন্য না।
- কাজের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় টুলস, সফটওয়্যারের ব্যবহার শিখুন।
- নিয়মিত খুঁটিয়ে বিজনেস পেপার, জার্নাল, ফিনান্সিয়াল এসেসমেন্ট ইত্যাদি পড়ার অভ্যাস করুন। এ পেশায় সফল হতে হলে ভাল রিডার হওয়ার বিকল্প নাই।
- বিভিন্ন ইনটারন্যাশনাল কোম্পানি নিয়ে পড়াশুনা করুন। তারা কিভাবে ইউনিক প্রবলেম সল্ভ করছে তা রিসার্চ করুন।
- ক্লায়েন্ট আকৃষ্ট করার জন্য আপনার যোগ্যতার অতিরিক্ত কিছু প্রমিজ করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখবেন রেপুটেশন খারাপ হলে এ পেশায় টিকে থাকা অত্যন্ত দুরূহ।
- নিয়মিত ঘুম এবং শারীরিক পরিশ্রম আপনাকে প্রো-অ্যাকটিভ হতে সাহায্য করবে।
- অন্যর অর্থে আবার লোভ করবেন না যেন!
- অহংকারী নয় বরং বিনীত হতে শিখুন। গুরুজনদের সম্মান করুন।
- সমস্যা নিয়ে বিচলিত হবার চেয়ে চেষ্টা করুন তার সমাধান নিয়ে কাজ করতে।