ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেসে কাজ করার কথা আমরা সবাই কম বেশী শুনে আসছি। অনেকেই ক্যারিয়ারে ফ্লেক্সিবিলিটির আশায় ফ্রিল্যান্সিং করতে চায়। কেউবা লোক মুখে শুনে আসছে তাই শখের বশে একাউন্ট খুলে ফেলছে। এত আগ্রহ থাকার পর ও এদের মাঝে অনেকেই এই ফিল্ডে বেশী দিন টিকে থাকে না। এর মেইন কারন হতে পারে ফ্রিল্যান্সিং কে তারা প্রাইমারি ফোকাসে রাখে নি। যার কারনে তারা দিক হারিয়ে ফেলছে।

বাংলাদেশে অনেক ফ্রিল্যান্সাররা কিন্ত বহুদিন ধরে কাজ করে সফল হয়ে আসছে এবং কন্টিনিউ করে যাচ্ছে সেই সেইম লেভেল এর ইন্টেনসিটি নিয়ে। তাদের সফলতার পিছনে রহস্য কিন্ত সিম্পল- ধৈর্য এবং নেভার গিভ আপ এটিটিউড। এদের মাঝেই আজ একজনের গল্প তুলে ধরবো। যাতে অনেকেই তাদের গল্পে ইন্সপায়ার হয়ে ফ্রিল্যান্স দুনিয়ায় নিজের নাম কামাতে পারে। 

আচ্ছা চিন্তা করুন তো কেমন হবে ব্যাপারটা যখন শুনবেন পত্রিকার এক আর্টিকেল থেকে সাকসেসফুল ফ্রিল্যান্সার হওয়ার পথে যাত্রা শুরু? শুনতে ইন্টারেস্টিং লাগছে না! হ্যাঁ, মিজানুর রহমান শোয়েব এর কাহিনিটি কিন্ত এরকমই। 

ফ্রিল্যান্সিং শুরুর কাহিনী

বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষকতার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার পরিচয়টাকে বেশ প্রাধান্য দেন তিনি। তো জানতে চেয়েছিলাম এসব কিভাবে শুরু করা… 

“ধন্যবাদ। আসলে ২০১২ সালের শেষের দিকে প্রথম আলো পত্রিকায় ফ্রিল্যান্সিংয়ের উপর একটা আর্টিকেল পেয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে একটা ধারণা লাভ করিপরবর্তীতে যাত্রাবাড়ির একটি কোচিং সেন্টার থেকে কিছু কোর্স শুরুর মাধ্যমেই এই পেশাতে আসা।“

অনুপ্রাণিত করেন যিনি তারও তো অনুপ্রেরণার উৎস লাগে! হ্যা বিশেষ ক’জন মানুষ আছেন যাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ।

ফ্রিল্যান্সিং এ তার অনুপ্রেরণা

এমন কেউ কি আছেন যিনি আপনাকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, “ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যাপারে প্রথম অনুপ্রেরণা পেয়েছি কোচিং-এ আমার প্রথম শিক্ষক মোঃ আমিন আহমেদ স্যারের কাছ থেকে। এছাড়াও আমার পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে আমার মামা সুমন পাটওয়ারি আমাকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যাপারে অনেক উৎসাহ ও সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে PrimeIT এর শিক্ষক মোঃ জহিরুল ইসলাম স্যার এবং বিজকোপ এর নাহিদ হাসান ভাইয়া আমার চলার পথে অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে আমি তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ। কারণ চলার পথে এরকম পাথেয় না থাকলে এতদূর আসা যায় না।“

আপওয়ার্কের সাথে পরিচয়

সব ছেড়ে কেনো আপওয়ার্কেই (Upwork) কাজ করা সেই প্রসঙ্গে আসলে তিনি বলেন, 

“আমিতো ভাই কেবল আপওয়ার্কেই (Upwork) এ কাজ করি কারণ আমার মতে আপওয়ার্ক সেরাদের সেরা। হ্যাঁ টপটাল (

Toptal), ফাইভার বা ইভান্টো (Evanto) ও দারুণ। কিন্তু এটা বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে’ নির্ভরযোগ্য ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইট। এখানে কাজের পারিশ্রমিক পাবার নিশ্চয়তার পাশাপাশি বিচিত্র কাজ শেখার সুযোগ রয়েছে। সত্যি বলতে নিজেকে একজন আপওয়ার্কার হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। আপওয়ার্কের ভাবটাই আলাদা!”

বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে খাপ খাইয়ে নেয়া

মিজানুর রহমান শোয়েবআপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো প্ল্যাটফর্মে খাপ খাইয়ে নেয়া সত্যি খুব জরুরি ব্যাপার। শিক্ষক বলেই উনার কাছে ভালো একটা ব্যাখ্যা আশা করেছিলাম আমরা। আর তিনিও খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দিলেন।

“দেখুন প্রত্যেক ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মেরই একটা স্বকীয় ফাংশনালিটি রয়েছে। আপনাকে সেই ছাঁচে বেড়ে উঠতে হবে, কাজ করতে হবে। আপনি এটাকে কোনো পরিবেশে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার সাথে তুলনা করতে পারেন। এই যেমন ফাইভারের ক্ষেত্রে আপনাকে জানতে হবে কি করে গিগ বানাতে হয়, কিভাবে গিগ বানালে ভালো একজন সেলার হতে পারবেন অর্থাৎ দিনশেষে বায়ার পাবেন ইত্যাদি। আবার আপওয়ার্কের ক্ষেত্রে আপনাকে ম্যানার বজায় রেখে প্রোপোজাল লিখতে হবে, পোর্টফোলিও বানাতে হবে, নিশ মোতাবেক প্রোজেক্টে বিড করতে হবে এসব। তাছাড়া প্রত্যেক প্ল্যাটফর্মেরই কিছু ডুজ এন্ড ডোন্টস (Do’s & Don’ts) আছে। ওসবের সাথে মানিয়ে নিতে হয়।“

প্রোফাইল সাজানো

প্রোফাইল তৈরির ব্যাপারটাও অনেককে ভোগায়। আবার অনেকে এতো অতিরঞ্জিত করেন যে ক্লায়েন্টরা একবার দেখেই সটকে পড়ে। আর ফিরেও তাকায় না। এ ব্যাপারে কিছু বিশেষ পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি বলেন-

“প্রথম পরামর্শটা সততার। নিশ সিলেকশানের (Niche Selection) পর আপনি যেটুক স্কিল ডেভেলপ করতে সক্ষম হয়েছেন ঠিক সেটুক প্রদর্শন করুন। বাড়িয়ে দেখাবেন না। ওটা করতে গেলে নির্ঘাত ধরা খাবেন। যতোটা সম্ভব নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রোফাইল তৈরি করা উচিত। প্রোফাইল ডেস্ক্রিপশন একবার লিখে রাখলেই হলো এমনটা ভাবা যাবে না। নিজ নিজ স্কিল এবং অভিজ্ঞতার আলোকে নিয়মিত আপডেট করতে হবে। একইসাথে নিজের টার্গেট মার্কেটটা ঠিক রাখুন। এছাড়া অভিজ্ঞতা নেই তো কি হয়েছে, জব-বোর্ডের রিকোয়ারমেন্ট ধরে ধরে স্যাম্পল বানাতে হবে এবং পোর্টফোলিওতে জুড়ে দিতে হবেক্লায়েন্টদের কমন চাহিদাগুলো বুঝে নেয়া জরুরি। 

প্রোপোজাল এবং গিগ তৈরি

এবং এর পরপরই প্রোপোজাল এবং গিগ লিখার ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করেন তিনি…

“নিঃসন্দেহে। প্রোজেক্টে কাজের সুযোগ পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে মূলত এর উপরেইআপনি বায়ার বা ক্লায়েন্টের জব রিকোয়ারমেন্ট বুঝেছেন কিনা এবং সেটা করার মুরোদ আপনার আছে কিনা তা অনেকটা ফুটে উঠবে এখানেই। প্রতিষ্ঠিত ফ্রিল্যান্সাররা কিভাবে প্রোপোজাল লিখে তার নজির আপনি গুগোলেই পাবেন। ফাইভারের হাই-প্রোফাইল সেলাররা কিভাবে গিগ লিখেছে দেখে শিখুন। ফ্রিল্যান্সার ডট কমে (Freelancer.com) কিভাবে তারা প্রোপোজাল লিখছে সচক্ষেই জেনে নিতে পারবেন।“ 

লক্ষ স্থির করা

একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনি কি লক্ষ্যে কাজ করেন এমন কৌতুহলের জবাবে মিজানুর রহমান মন জুড়ানো কিছু কথা বললেন। এক কথায় অসাধারণ শিক্ষণীয় কিছু কথা!

“আমি সবসময়ই আমার ক্লায়েন্টকে সফল দেখতে চাই। আমি ধরেই নেই যে তার সফলতা মানে আমার সফলতা। আর সত্যি বলতে এটাই আমাকে পুরষ্কৃত করে বারবার। ফলে আমাকে টাকার পেছনে ছুটতে হয় না, টাকাই আমাকে খুঁজে নেয়! তাছাড়া দক্ষ-শিক্ষিত-দীক্ষিত মানুষ হিসেবে আপনার নিশ্চয়ই একটা দায়িত্ববোধ কাজ করবে। আমারও করে। আমি আমার যা কিছু আছে তাই দিয়ে পৃথিবীর জন্য কিছু করতে চাই। তাকে প্রগতিশীল দেখতে চাই। এই যা!”

প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কিছু বলুন

প্রোজেক্ট ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে অনেকেই হিমশিম খান। অদক্ষতার দরুন পরবর্তীতে ওই ক্লায়েন্টের কাছ থেকে আর কাজ পান না। এমনকি একইসাথে দুইটা ভিন্ন প্রোজেক্ট সামলাতে গেলেই ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি! তাছাড়া একজন ফ্রিল্যান্সারের এটিচুড কতো যে গুরুত্বপূর্ণ শোয়েব স্যারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে দারুন কিছু নির্দেশনা পাওয়া গেলো…

“আসলে একজন বায়ার এবং তার প্রোজেক্ট নিয়ে আমার যে মনোভাব (Attitude) কাজের বেলা সেটাই উঠে আসে। এই যেমন একজন ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে সর্বাগ্রে আমি প্রোজেক্টের উদ্দেশ্যটা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করি। প্রয়োজনে ক্লায়েন্টকে হালি হালি প্রশ্ন করি। ফোনে কথা বলি বা মেসেজ আদান-প্রদান চলে। অবশ্য এটাই পছন্দ ওদের। এছাড়া আমি কখনোই ডেডলাইন মিস করি না। বিশেষ সমস্যা হলে সময় চেয়ে নেই। আবার ধরেন লংটার্ম প্রোজেক্টের বেলায় নিয়মিত আপডেট দেই। অনেস্টলি সবসময়ই আমার চেষ্টা থাকে নিজের সেরাটা দেয়ার। আমি তাদের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা করি। ক্লায়েন্টদের আমি এমনভাবে ট্রিট করি যেনো তারা আমার খুব কাছের। এটা কোনো কষ্ট কল্পনাও নয়। কারণ যে আপনাকে কাজ অর্পন করেছে তার সাথে কৃতজ্ঞতাবশত এমন করাটাই সমীচীন বলে মনে হয় আমারতাছাড়া কখনো সখনো টিম ভিত্তিক কাজ করতে হয়। সেক্ষেত্রে টিম মেম্বারদের সাথে যথেষ্ট সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের পাশাপাশি প্রশংসা করাও আমার কাজের মধ্যে পড়ে। আর বিশেষ করে সফলভাবে প্রোজেক্ট শেষ করার পর খুব মার্জিতভাবে তাদেরকে কাজের রিভিউ বা ফিডব্যাক দিতে বলি।“  

সফলতার মূল সূত্র

জানতে চাইলাম, আপনি নিজেকে কতোটা সফল বলে মনে করেন। আর কোন ব্যাপারটাকে সফলতার মূল সূত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি একটা হাসি দিয়ে বলতে লাগলেন-

“হাহা! ঠিকাছে ফ্রিল্যান্সিং যেহেতু আমার পারসোনাল বিজনেস তো চলুন আর্থিক মূল্যেই বলি। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমানে প্রতি মাসে আমার গড় আয় প্রায় দুই হাজার ডলার। বুঝতেই পারছেন বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে একটা সুন্দর, স্বচ্ছল জীবনযাপনের জন্য এটা যথেষ্ট। তবে আমার সফলতার বোধ আসে ঐ যেমনটা বলছিলাম, ক্লায়েন্টকে সফল করে তোলার ভেতর দিয়ে। আর আমার সফলতার মূল সুত্র হলো আত্ম-সমালোচনা। ক্লায়েন্টের সমালোচনা আমলে নেই তো বটেই, তারচে’ বড় কথা নিজের ভেতর সর্বদাই এক আত্ম-সমালোচক পুষে রাখি। এটা আমার প্রোজেক্টকে পারফেকশানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়।“

চলার পথ কতটা কঠিন ছিলো?

সত্যি খুব ভালো লাগার মতো কিছু কথা! এই আলাপের সূত্রে তার ওই চলার পথ কতটা কঠিন ছিলো সেটাও আশা করি পাঠকের কাজে লাগবে।

তিনি জানান, “সত্যি বলতে আমার জন্য চলার পথটা মোটেও সহজ ছিলো না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র সরকারি চাকরি না করে ফ্রিল্যান্সিং করবে, তা সবার কাছেই অস্বাভাবিক, অগ্রহণযোগ্য ছিলোতখন আবার ফ্রিল্যান্সিং করার সঠিক নিয়ম বা ধারণা অনেকের কাছেই অজানা। তাই প্রথম দিকে বন্ধু, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হয়েছি তবে এ সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমার সফলতায় অনেকের মধ্যেই পরিবর্তন এসেছেআজ তারাই আমাকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেন।“

ক্লায়েন্টকে খুশি রাখার ৩ টা টিপস

এরপর অনেক দিন যাবত কাজ করার সুবাদে আমারা উনার কাছে ক্লায়েন্টকে খুশি রাখার ৩ টা টিপস অনুরোধ করি! তো উনার দেয়া টিপসগুলো চট করে পড়ে নেই চলুন।

নতুনদের জন্য পরামর্শ

এছাড়া নতুনদেরকে নিয়ে অনেক আশাবাদী হবার পাশাপাশি তাকে হালকা সতর্কতাও উচ্চারণ করতে দেখা যায়। তিনি বলছিলেন,

“আগে কাজ শিখে তারপর ফ্রিল্যান্সিং পেশায় আসতে হবে এবং প্রতিনিয়ত শেখার মন-মানসিকতা থাকতে হবেঅন্যথায় ভীষণ প্রতিযোগিতাপূর্ণ এসব মার্কেটপ্লেসে টেকা যাবে না। পাশাপাশি ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়াতে হবেএবং অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আমাদের শুরুর দিকে নাহয় অনেক কিছুই ছিলো না। কিন্তু আজ বাংলাদেশ পুরো পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফ্রিল্যান্সিং সোর্স। এটা তাদের বড় অনুপ্রেরণা হতে পারেতাদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো তারা অবশ্যই পারবে! ইন শা আল্লাহ, আমাদেরকেও ছাপিয়ে যাবে!”

আমরাও বিশ্বাস করি জনাব মিজানুর রহমান শোয়েবের আশাবাদ বাস্তবতার মুখ দেখবে খুব শিগগিরই!!