“পরবর্তী ২০ বছর সকাল ৭টা থেকে অফিস যাবার যুদ্ধটা করতে চাইনি বলেই ফ্রিল্যান্সিং বেছে নিয়েছি’

কাজী দ্রোহী রহমান, আপওয়ার্কের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার, সাবেক কর্পোরেট লিডার এবং সফল একজন মা হওয়ার সাথে (পাশাপাশি) কাজ করছেন বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটপ্লেসে। 

ফ্রিল্যান্সিং এ পথচলা

পড়াশোনা শেষ করে কর্মহীন জীবনযাপনে আগ্রহী ছিলেন না মোটেও। সমসময়ই চেয়েছেন নিজে কিছু করে স্বাবলম্বী হতে। কাজী দ্রোহী রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে স্বনামধন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন কাজ করার পর যোগ দেন কর্পোরেট কোম্পানিতে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ৯-৫ টার রুটিন আর টানা কাজের চাপ থেকে তুলনামূলক স্বস্তির কোন পেশায় নিজের মত ক্যারিয়ার শুরু করার ইচ্ছাটাও তখন জেঁকে বসে। 

চাকরীর পাশাপাশি খুঁজতে থাকেন বিকল্প কোন পেশা। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কাজী দ্রোহী রহমানের জানাশোনাও তখন শুরু হয়। টুকটাক লোকাল কাজ আর মার্কেটপ্লেস নিয়ে ঘাটাঘাঁটির এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন ফ্রিল্যান্সার একাউন্ট করার।  তেমন কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও সতীর্থ এক কলিগের সহযোগিতায় ২০১৩ তে তৎকালীন অডেস্ক মার্কেটপ্লেসে একাউন্ট করেন।  

রেজিস্ট্রেশনের প্রায় এক মাস পর দ্রোহী প্রথম কাজের অফার পান। ভার্চুয়াল সাপোর্টের কাজটা সফলভাবে করার পর আরো বেশ কিছু প্রজেক্টে কাজ করেন।

কাজের প্রতি যত্ন আর প্রফেশনাল সার্ভিসের ফলে দ্রোহীর ফ্রিল্যান্স ক্যারিয়ারের শুরুতে সাফল্য পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তবে, ব্যক্তিগত কারণে এর পর ৩বছর ফ্রিল্যান্সিং এর বাইরে ছিলেন।

ফ্রিল্যান্সিং এ কাজী দ্রোহী রহমান কাজ করছেন মূলত এডমিন সাপোর্ট ক্যাটাগরিতে। ক্লায়েন্টদের ব্যক্তিগত প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে সেলস সার্ভিস, ব্যাকএন্ড অফিস সাপোর্ট, ইমেইল হ্যান্ডলিং ইত্যাদি সার্ভিস দিয়ে থাকেন। অফিস এডমিনিস্ট্রেশনে দক্ষ এ ফ্রিল্যান্সার ভার্চুয়াল এসিস্টিং এর পাশাপাশি ইদানীং সফটওয়্যার অটোমেশন আর গ্রাফিক্স নিয়েও বেশকিছু কাজ করেছেন। 

ফ্রিল্যান্সিং এ সামনের পরিকল্পনা কি জানতে চাইলে কাজী দ্রোহী রহমান বলেন, “ ডাটা সায়েন্স নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে, এজন্য নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি।  আর আমি ফ্রিল্যান্সিং এর দক্ষতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাই কন্টিনিউয়াস নিজের স্কিল ইম্প্রভমেন্টে সময় দেই।’

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দ্রোহী বর্তমানে আপয়ারকের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। এছাড়া এ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে অবস্থান করছেন শীর্ষে। 

 ফ্রিল্যান্সিং কেন

কাজ করতেন প্রাইভেট ব্যাংকে। অভিজ্ঞতা রয়েছে কর্পোরেট সেক্টরেও কাজ করার। হতে পারতেন একজন ব্যাংকার। পেশাদারি প্রথিস্থিত ক্যারিয়ার ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিং কেন পছন্দ? জানতে চাইলে বলেন,

“আমি সবসময়ই চেয়েছি নিজের স্বাধীনতামত জীবনযাপন করার। উপার্জনের স্বাধীনতা আর ফ্লেক্সিবল পেশায় কাজ করার। ফ্রিল্যান্সিং এ পরিবার, সন্তানের দায়িত্ব পালনের সাথে  সুযোগ পেয়েছি নিজ পছন্দের ক্যারিয়ার গড়ার। যাতায়াতের ভোগান্তি আর  কাজের চাপে একটা সময় ব্যক্তিগত জীবনে স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে, কিন্তু এখন পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফ সুন্দরমত মেইন্টেইন করতে পারি যা এ পেশায় সম্ভব হয়েছে। আবার প্রফেশনাল গ্রোথের কথা ভাবলে আমি মনে করি ফ্রিল্যান্সিং এ স্কাই ইজ দ্যা লিমিট!”

ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটপ্লেসে এডমিনিসট্রেটীভ সাপোর্ট নিয়ে কাজ করতে চাইলে কি ধরনের দক্ষতা প্রয়োজনঃ 

“এডমিন সাপোর্ট বা ভার্চুয়াল এসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করতে চাইলে তেমন টেকনিক্যাল দক্ষতার  প্রয়োজন হয়না। আমি মনে করি ফ্রিল্যান্সিং এর অন্য যে কোন সেক্টরে কাজের জন্য যে বেসিক যোগ্যতার প্রয়োজন তা দিয়েই শুরুতে এডমিন সাপোর্টের কাজ করা যায়। পাশাপাশি ওয়েব রিসার্চ, ইংরেজিতে ভাল কমুনিকেশন স্কিল, মাইক্রোসফট অফিস, গুগল স্যুইট,  ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা  থাকলে মোটামুটি এডমিন সাপোর্ট রিলেটেড সব ধরনের কাজ করা যায়।

পরবর্তীতে আপনি চাইলে স্পেসিফিক কোন এরিয়া যেমন, ডাটা ম্যানেজমেন্ট, সিএমএস বা লে্টেস্ট ডিমান্ড অনুযায়ী কোন সেক্টরে স্কিল আপডেট করতে পারেন। বর্তমানে যেমন এআই এবং অটোমেটেড সফটঅয়্যারে দক্ষ ফ্রিল্যান্সারের চাহিদা বেশি। তবে ভাল ভাষা জ্ঞান আর দ্রুত এডেপটিবিলটি এ সেক্টরে সফল হতে সাহায্য করবে। ‘

মেয়েদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং এর চ্যালেঞ্জ

প্রচলিত পেশার বাইরে গিয়ে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার গড়া কাজী দ্রোহী রহমানের জন্য মোটেও সহজ ছিলোনা। সামলাতে হয়েছে নানা পারিবারিক বাধা-বিপত্তি।  কাজী দ্রোহী রহমানের মতে, “কাজের প্রতি অনেস্টি আর ডিসিপ্লিন্ড লাইফস্টাইল হলে একটা মেয়ের পক্ষে ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি পেশাদারি ক্যারিয়ারও ভালভাবে ব্যবস্থাপনা সম্ভব। যদিও ফ্রিল্যান্সিং এ ফিজিক্যাল প্রেজেন্স লাগেনা, কিন্তু নিয়মিত ক্লায়েন্ট কমুনিকেশন, সময়মত কাজের ডেলিভারি, নিজেকে আপডেটেড করার জন্য সময় দেয়া ইত্যাদি মাস্ট। যেটা একটা মেয়ের জন্য নিয়মিত মেইন্টেইন করাটা কষ্টকর। এছাড়া রেগুলার কাজের চ্যালেঞ্জ তো আছেই। কাজে বিড করা, ক্লায়েন্ট হ্যান্ডলিং, ডেডলাইন ঠিক রাখা ইত্যাদি থাকলেও আমি অন্যান্য ফুলটাইম পেশার চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন একটা মেয়ের জন্য ফ্রিল্যান্সিং কম ঝামেলার বলেই মনে করি।’

ফ্রিল্যান্সিং এ মেয়েদের সুযোগ কেমন?

‘ফ্রিল্যান্সিং মানে যোগ্যতা। আমার মতে দক্ষতা থাকলে ফ্রিল্যান্সিং এ মেয়েদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।শুধু মেয়েদের নয়, ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই বর্তমানে ফ্রিল্য্যান্সিং স্মার্ট ক্যারিয়ার চয়েজ।  আবার মেয়েদের নানা বাধ্যবাধকতার কথা চিন্তা করলেও মুক্তপেশা ফ্রিল্যান্সিং এ এসবের ঝামেলা কম । এ সেক্টরে কাজের সময় আপনার ফ্লেক্সিবিলিটির ওপর নির্ভর করে। অফিস জবে  যেখানে বাঁধাধরা রুটিন ফলো করতে হয়, ফ্রিল্যান্সিং এ  পছন্দমত সময় ভাগ করে কাজ করা যায়। এমনকি রিমোট জবেও বাসায় বসেই সুবিধামত টাইমজোনে কাজ করতে পারেন। 

আবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে মেয়েদের পারিবারিক সামাজিক রেস্পন্সিবিলিটি সামলানোর সাথে প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে ভাল করা প্রতিবন্ধক; ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে তা তুলনামূলক সহজ। পরিশ্রমের মূল্যায়ন, আর্থিক সুবিধা সবমিলিয়ে আমি মনে করি আমাদের দেশের মেয়েদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং বেটার ক্যারিয়ার অপশন’ 

ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগে কি ধরনের প্রস্তুতি নেয়া দরকার?

“সবার আগে পড়াশোনার অভ্যাস তৈরি করা! না, একাডেমিক পড়াশোনা নয় তবে পেশাগত পড়াশোনার অভ্যাস থাকতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে ইন্টারনেটে বহু রিসোর্স পাবেন, সেগুলো খুঁজে বের করুন। কাজে দক্ষ হলে দেখুন, কোন মার্কেটপ্লেসে আপনার স্কিলের কাজ পাওয়া যায়, ক্লায়েন্ট ডিমান্ড কেমন ইত্যাদি। শুধু স্কিল থাকলেই হবেনা, মার্কেটে আপনার স্কিলের ডিম্যান্ড কেমন তাও খুঁজে দেখতে হবে। আর দক্ষ না হলে নিজেকে স্কিল্ড করায় মনযোগ দিন। রিসার্চ করুন, দেখুন নতুন কি শেখা যায়। ইন্টারনেটে প্রচুর রিসোর্স পাবেন। খুঁজে বের করে স্টাডিতে সময় দিন।”