অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু-বিভাগীয় গবেষণা ও শিক্ষাদান বিভাগ অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউট (ওআইআই) এর এক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং এ বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বার্ষিক ১০ কোটি ডলার আয় করছে। বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সার এর ২৪ শতাংশ নিয়ে ভারত শীর্ষে অবস্থান করছে, এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশর ফ্রিল্যান্সার এর সংখ্যা বিশ্বে ১৬ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশে ভেদে ফ্রিল্যান্সারদের ধরন আলাদা। বাংলাদেশ এর ফ্রিল্যান্সাররা বিক্রয় ও মার্কেটিং সেবায় এগিয়ে আছে। 

বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং এর অবস্থা

বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা ফোর্বস এর তথ্যমতে ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রিল্যান্সিং আয়ে বাংলাদেশ এর অবস্থান অষ্টম এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। বিশ্বে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে। বাংলাদেশে এই খাতে আয় ১ বিলিয়ন হলেও, সম্ভাবনা আছে ৫ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু এই ৫ বিলিয়ন ডলার আয় এর লক্ষ্য পূরন করতে প্রয়োজন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার এর সরকারি বিনিয়োগ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক উন্নতি করেছে যার ফলে বাংলাদেশের আয় ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পেরেছে কিন্তু বাংলাদেশের সামনে ফ্রিল্যান্সিং খাতে বিরাটা সুযোগ রয়েছে। আর এ খাতে ভালো কর‍তে হলে অবকাঠামো এবং ইন্টারনেট সুবিধা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ফ্রিল্যান্সিং একটি সম্ভাবনাময় খাত। কারন যেখানে দেশের চাকরির বাজার বেশ নাজুক অবস্থায় আছে, যেখানে ৪৭% শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার, পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয় না, সেখানে বিকল্প পেশা হিসেবে সম্মানজনক অবস্থায় আছে ফ্রিল্যান্সিং। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ তরুণদের প্রতি ১০ জনের একজন বেকার। প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো হাজার হাজার শিক্ষার্থী মনের মতো চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে আছেন। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু এই বেকার জনগোষ্ঠীকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। 

ফ্রিল্যান্সিং খাতে সরকারি উদ্যোগ

ফ্রিল্যান্সিংকে খাত হিসেবে আরো সফল করতে সরকারি উদ্যোগই বেশি প্রয়োজন। ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণার দশ বছর পর সরকার ‘আমার গ্রাম-আমার শহর, সুশাসন’ ও তারুণ্যের শক্তি’- এই তিনটি উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়। তাতে ডিজিটাল বিপ্লবের বাস্তবায়ন আরো ‘গতিশীল’ হয়েছে। এই রোডম্যাপ অনুযায়ী সরকার ইতিমধ্যে নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ। আইসিটি মন্ত্রনালয়ের অধীনে লার্নিং এন্ড আর্নিং প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশব্যপী চল্লিশ হাজার প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সরকার পাঁচ লক্ষ ফ্রিল্যান্সারদের স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। ইতিমধ্যে, আইসিটি বিভাগ এবং বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভলপমেন্ট সোসাইটি ফ্রিল্যান্সারদের ডাটাবেইজ তৈরি করেছে। এছাড়া সরকার তথ্য প্রযুক্তি সেবা নিশ্চিত করতে প্রতি জেলায় আইসিটি পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের ফ্রিল্যান্সারদের সরকারি কাজ করার সুযোগ দিতে একটি মার্কেটেপ্লেস তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে । যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরও এই কার্যক্রমে নানান প্রশিক্ষণ ও ভাতার ব্যবস্থা করছে। সরকারিভাবে বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গুলোকেও নানা ভাবে সাহায্য করছে সরকার।

সরকারি নানা উদ্যোগের পরেও এখনো বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বাংলাদেশের। যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ইন্টারনেট সেবার মান এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অধিক মূল্য। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ইন্টারনেটের বিকল্প নেই। ঢাকাতে ইন্টারনেট আগের চেয়ে কিছুটা সহজলভ্য ও গতি সম্পন্ন হলেও ঢাকার বাইরে ইন্টারনেট সেবার মান আরো বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশি। সেখানে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা পেতে অনেক টাকা ব্যয় কর‍তে হয়। এছাড়া যেসব এলাকা ব্রডব্যান্ড সংযোগ এর আওতায় নেই সেখানে টেলিকম ইন্টারনেট ব্যাবহার ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই, যা অনেক ব্যয়বহুল এবং কম গতিসম্পন্ন। দেশের সর্বত্র ব্যান্ডউইথের মাত্রাও এক নয়। তাই সরকারের উচিৎ দ্রুত গতির নেটওয়ার্ক সর্বত্র বিস্তৃত এবং সহজলভ্য করা এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা। 

ফ্রিল্যান্সিং এর আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে টাকার সহজ লেনদেনের ব্যবস্থা। বিশেষ করে বিদেশ থেকে টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সহজ কোনও উপায় নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে অনলাইন পেমেন্ট মেথড হিসেবে পেওনিয়ার, স্কিল, পেইজা, নেটেলার, জুম চালু আছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে অনলাইন অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় পেপাল। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পেপাল সেবা চালু করা হয়নি ফলে ফ্রিল্যান্সারদের উপার্জিত অর্থ গ্রহণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের জন্য পেমেন্ট মেথড নিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়, ব্যয় হয় অতিরিক্ত অর্থ। যদিও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং পেপালের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং কাজ চলমান আছে। পেপাল কর্তৃপক্ষ বাজার যাচাইসহ নানা পরীক্ষা চালিয়েছে। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা ভেবে বাংলাদেশে পুরোপুরি পেপাল সেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নয়টি ব্যাংকের সাথেও সরকারি উদ্যোগে আলোচনা হয়েছে। এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালোয়ও পেপালের সঙ্গে আলোচনা চলমান রেখেছে। পেপাল সেবা চালু হলে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা উপকৃত হবেন। এ ছাড়া রেমিট্যান্স আসার হার বাড়বে। ডিজিটাল ট্রানজেকশন বাড়বে। তাই সরকারের উচিত দেশে দ্রুত পেপাল সেবা চালু করা জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া।  

ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সরকার ইতোমধ্যে এই খাত নিয়ে কাজ করছে। সরকারের যথাযথ বিনিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে এই সম্ভাবনায় খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্জন এবং বেকার সমস্যা দূর করা সম্ভব।