ডিজিটালাইজেশনের আগমনের সাথে সাথে বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ ডিজিটাল অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করছে। একটি দেশের অর্থনীতির ডিজিটালাইজেশন কেবল তার শিল্পে নতুনত্বকে চালিত করে না, এটি গার্হস্থ্য কর্মসংস্থানের সুযোগকেও উন্নীত করে, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সক্ষম করে। ব্যয় এবং ঝুঁকি হ্রাসের সন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলির অনেকগুলি বড় কর্পোরেশন বাংলাদেশসহ নানা দেশ থেকে আইটি আউটসোর্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছে, যা বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিংকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। বৈশ্বিক ডিজিটালাইজেশন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ‘ডিজিটাল ইকোনমাই রিপোর্ট-২০১৯’ মতে, বৈশ্বিক এ খাতে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন, যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে ১০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক ডিজিটালাইজেশন শুধু পণ্য ও সেবার উদ্ভাবনই বাড়ায় না, সাথে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি করে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জোরালো করে। 

ফ্রিল্যান্সিং এর সুবিধা

ফ্রিল্যান্সিং কাজের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, অডিট প্রস্তুতি, এডোবির কাজ এবং সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন সবকিছু অন্তর্ভুক্ত। এটি উদীয়মান বাজারগুলিতে মানুষের জন্য বিস্তৃত নতুন সুযোগ তৈরি করেছে যা আগে এতো বেশী বেশি ছিল না। এশিয়া বিশ্বজুড়ে আউটসোর্সিং এর ক্ষেত্রে নামকরা জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর সেই জায়গায় বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। ফ্রিল্যান্সারদের চাহিদা বর্তমানে অনেক বেশী। তার একটি কারণ এই খাতে কাজের পরিমাণ অনেক বেশী। এ ধরনের কাজের সুবিধাও অনেক। বিশেষ করে গ্রাহক ও কাজের  পরিসর অনেক মুক্ত। বিশ্ব বাজারে কাজ করা যায়, কাজের স্থান নিয়েও ভোগান্তি নেই। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ফ্রিল্যান্সারদের ঢাকার মতো জনবহুল শহরের রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে অফিস যেতে হয় না। নেই কোন যাতায়ত খরচ বা আলাদা খাবার খরচ। ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে নতুন চাকরি বাজার তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে অনেক সুযোগ। এখন আউটসোর্সিংয়ের বাজার সবচেয়ে বড় এশিয়াতেই।  স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে এখান থেকে ভালো আয় করার সুযোগ রয়েছে। দ্রুতগতিতে বাংলাদেশে ডিজিটাল রুপ লাভ করায়, শহরে ইন্টারনেট সুবিধা, সরকারি-বেসরকারি প্রচারণায় এই খাত ধীরে ধীরে সবার কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এবং প্রতিদিনই বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ তরুণদের প্রতি ১০ জনের একজন বেকার। প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো হাজার হাজার শিক্ষার্থী মনের মতো চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে আছেন। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে খুব সহজেই ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে নানা সুযোগ রয়েছে।  বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, এতে করে তারা শুধু নিজের জীবিকাই নিশ্চিত করবে না, বরং দেশে অনেক বৈদেশিক মুদ্রাও অনবে সমর্থ হবে যা ‘নতুন বাংলাদেশ’র অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

ফ্রিল্যান্সিং এর বাজার যেহেতু প্রতিদিনই বড় হচ্ছে এবং কাজের জন্য কোন পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই তাই বাংলাদেশি যুব সমাজের জন্য ফ্রিল্যান্সিং একটি অনন্য সুযোগ। প্রশিক্ষণ নিয়ে অল্প কদিনের মধ্যেই এই খাতে উপার্জন করা সম্ভব।

ফ্রিল্যান্সিং এর অবদান ও গুরুত্ব

বিগত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে ফ্রিল্যান্সারদের অবদান লক্ষণীয়। দেশের বার্ষিক আয়ের এক উল্লেখযোগ্য অংশ আসে তাদের কাজের মাধ্যমে। বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ফ্রিল্যান্সররা ১০ কোটি ডলার আয় করে থাকেন। শ্রমব্যয় কম থাকায় বিশ্বের আউটসোর্সিং বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। 

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু-বিভাগীয়ভ গবেষণা ও শিক্ষাদান বিভাগ অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউট (ওআইআই) এর এক গবেষণায় প্রকাশিত  হয়েছে যে অনলাইন শ্রমিক সরবরাহে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার এর সংখ্যা বিশ্বে ১৬ শতাংশ। বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা ফোর্বস এর তথ্যমতে ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের  মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রিল্যান্সিং আয়ে বাংলাদেশ এর অবস্থান অষ্টম এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। বিশ্বে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে। বাংলাদেশে এই খাতে আয় ১ বিলিয়ন হলেও, সম্ভাবনা আছে ৫ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু এই ৫ বিলিয়ন ডলার আয় এর লক্ষ্য পূরণ করতে ফ্রিল্যান্সার এর সংখ্যা ৫ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। 

যুবসমাজের বিশাল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ, এশিয়ার কয়েকটি দেশগুলোর মধ্যে একটি। এর ১৬৩ মিলিয়ন লোকের মধ্যে প্রায় ৬৫% পচিশ বছরের কম বয়সি। এই বিশাল, তরুণ ও শক্তিশালী মানবসম্পদ, এখনো প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক বাজারে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়জ্ঞানের অভাব রয়েছে। যদিও ক্যারিয়ার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং গত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, হাজার হাজার বাংলাদেশের তরুণ এই সুযোগটি কাজে লাগাতে তাদের সহায়তা করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সরকারি সহায়তার প্রয়োজন। আমাদের আইটি সেক্টর এবং আইটি উন্নয়নের উত্থানের কারণে বাংলাদেশে আউটসোর্সিং বেড়েছে। দেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারকে এই খাতে জোরদার হতে হবে যা প্রচুর বিদেশি রেমিট্যান্স উৎপাদন করতে পারে। আউটসোর্সিং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে এবং তা অর্থনীতির সার্থকতা অব্যাহত রাখবে বলে ধারণা করা যায়।