বৈশ্বিক ডিজিটাইজেশন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবাদে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠছে এখন বাংলাদেশ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ‘ডিজিটাল ইকোনমাই রিপোর্ট-২০১৯ অনুযায়ী, বৈশ্বিক এ খাতে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন, যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে ১০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের আইটি খাতে ৩ লাখের বেশি পেশাজীবী কাজ করছে। ফ্রিল্যান্সিং এর পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছেন দেশের নারীরা। কমছে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য। ২০২০ সালের কোভিড ১৯ পরিস্থিতি ফ্রিল্যান্সিং খাতকে বিশেষত নারীদের জন্য নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

ফ্রিল্যান্স এবং নারী

ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এখন বেশ আলোচিত একটি বিষয়। বিশেষ করে তরুণ যুব সমাজের কাছে, যারা পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের পথ গড়ে তুলতে চায়। ফ্রিল্যান্সিং এমন একটি পেশা যেখানে যে কেউ তার মেধা দিয়ে শূন্য থেকে বেশ বড় সফলতা বয়ে আনতে পারে এবং তথ্যপ্রযুক্তি এমন একটি সেক্টর, যেখানে মূলত মস্তিষ্কের কাজ করতে হয়। এখানে কোথাও শারীরিক শক্তি দেখিয়ে কাজ করার উপায় নেই। এটা ছেলেদের আর এটা মেয়েদের কাজ- এরকম কোনো বিভাজনের সুযোগ নেই। নারী-পুরুষ দুজনেরই কিন্তু সমান মেধা থাকে। বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার কিন্তু ছিলেন একজন নারী, যার নাম লেডী এডা লাভলেস। ফেসবুকের প্রধান অপারেটিং অফিসার শেরিল কারা স্যান্ডবার্গ। গিটহাবের সাম্প্রতিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওপেন সোর্স প্রজেক্টে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের প্রোগ্রামিং কোড গৃহীত হওয়ার হার বেশি। কাজেই তথ্যপ্রযুক্তি ক্যারিয়ারে নারীদের সম্ভাবনা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল যে, ঘরে বসেই অনেক কাজ করা সম্ভব। একটা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই সমস্ত পৃথিবী চলে আসে হাতের মুঠোয়। যদি কোনো নারী কাজ জানেন, তাহলে বাইরে কাজ করার পাশাপাশি ঘরে বসেও প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনিং, আউটসোর্সিং বা ই-কমার্স বিজনেসের কাজ করতে পারেন।

বর্তমানে ফ্রিল্যান্স খাতে নারী অংশগ্রহণ

গত কয়েক বছরে ফ্রিল্যান্সিং খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বহুগুণে বেড়েছে। সরকারি হিসেবমতে ২০১৩ সালে তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে ৯% নারী কাজ করতেন। যদিও, তথ্যপ্রযুক্তিতে কর্মরত নারীদের হার সারা বিশ্বেই কম। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ২০১৫ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে ১৬% নারী কাজ করতেন। এক পরিসংখ্যানমতে, বাংলাদেশে শুধু প্রোগ্রামিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার জন্য মাত্র ১% মেয়ের আগ্রহ রয়েছে। তবে এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নানা কার্যক্রম পরিচালনার ফলে বর্তমানে তাদের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ অনেক বেড়েছে। তাছাড়া সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা নারীবান্ধব করা হয়েছে। নারীদের আইসিটিতে নিয়ে আসতে এবং ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সারাদেশে আইটি খাতে নারী অংশগ্রহণ নিয়ে কাজ করছে, আইসিটিকে পেশা হিসেবে নেয়ার জন্য সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা সরকার করছে। এ সুযোগগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও অনেক বাড়বে। 

প্রযুক্তি খাতে নারীদের বাধা

অন্য আর দশটা পেশার মতো এক্ষেত্রেও আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক বাধা মূলত নারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। আমাদের পুরুষত্রান্ত্রিক সমাজে নিয়ম হচ্ছে ছেলেরা বাইরে কাজ করবে আর মেয়েরা বাসায় থাকবে। মেয়েদের চিন্তার গন্ডিও কম। নারী স্বাক্ষরতার হার কম হওয়ায় তারা আইটি ক্ষেত্রে দক্ষ হতে পারেন না এবং ফ্রিল্যান্সিং খাতে তাদের অংশগ্রহণ কম থাকে।

অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সিংকে বাংলাদেশের সমাজে কখনোই খুব উচু মানের কাজ মনে করা হয়নি। নতুন ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে শতকরা ৬০ ভাগ বাবা মা সন্তানদের ফ্রিল্যান্সিং করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। ছেলেদের ক্ষেত্রে তারা বাবা মা কে অমান্য করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে সহজেই। কিন্ত মেয়েদেরকে নানানভাবে চাপে ফেলায় এবং নারীর ক্ষমতায়ন দূর্বল হওয়ায় একজন নারী চাইলেই ফ্রিল্যান্সিংকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারেন না।

প্রযুক্তি খাতে নারীদের সম্ভাবনা

বর্তমান সময়ে ‘পুরুষ উত্তম, নারী অধম’ এই ধারণাটা অনেক বদলে গেছে। এখন অনেক স্বামীই তার স্ত্রীকে বাইরে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রদান করছেন। কিন্তু যারা বাইরে গিয়ে কাজ করতে অনিচ্ছুক তাদের জন্যে ফ্রিল্যান্সিং হতে পারে উপার্জনের হাতিয়ার। এর ফলে স্বামীর পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেন নারীরা। তাছাড়া পারিবারিক জীবনের সাথে কর্মজীবন স্বাচ্ছন্দ্যে চালিয়ে যেতে ভালো রকমের বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। নারীদের ঘরে-বাইরে দুদিকে সামলাতে হয়।  সেক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিং নারীকে নিজের রুটিন নিজে মত করে সাজিয়ে নেবার সুযোগ দিচ্ছে। ১০ টা থেকে ৫টা অফিস করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ফ্রিল্যান্সিং এ নেই। নারীরা প্রথাগত চাকরির চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও সুবিধা পেয়ে থাকেন ফ্রিল্যান্সিং এ। যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো সময় কাজ করা যায়, রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে অফিসে যেতে হয় না, নিজের বাসায়ই কাজ করা যায়। পরিবার ও শিশুকে সময় দিয়েও আত্মনির্ভরতার সুযোগ করে দেয় ফ্রিল্যান্সিং।

নারীরা নিজের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে, সঠিক পরিকল্পনা করে পেশাদারিত্বের সাথে নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ করতে হবে। নারী-পুরুষ সবাইকেই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করে এগিয়ে যেতে হবে। এই এগিয়ে যাবার পথে ফ্রিল্যান্সিং হতে পারে নারী স্বাধীনতার এক অনন্য উপায়।