আতিকুর রহমান একজন পেশাদার ওয়েব ডেভলপার এবং ফ্রিল্যান্সার। একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং যাত্রা সাফল্যের এক অনন্য উদাহরণ। আমরা তার গল্পটি জানার চেষ্টা করেছি এবং তার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা তার যাত্রা নিয়ে জানবো।

আতিকুরের পথচলার শুরু

আতিকুর ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার ক্যাফেতে এইচটিএমএল, সিএসএস শেখার জন্য ব্লগ লিখতে শুরু করেন। তখন তার নিজের কম্পিউটার ছিল না। কিছু দিনের মধ্যে, তিনি নিজের নামে একটি ব্লগ সাইট তৈরি করেন এবং গুগল অ্যাডসেন্স এবং মাইক্রো সাইটগুলিতে কাজ শুরু করেন। তারপরে তিনি নিজের টাকায় একটি কম্পিউটার কিনেছিলেন। একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার হবার পরে, জিনিসগুলি আরও সহজ হয়ে যায় তার জন্যে। তিনি বলেন, ‘২০১১ এর শেষে আমি জাভাস্ক্রিপ্ট, পিএইচপি, জেকুয়েরি এবং বিশেষত ওয়ার্ডপ্রেস সফ্টওয়্যার সম্পর্কে আমার দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি আপওয়ার্ক (পুরাতন ওডেস্ক) নিয়ে কাজ শুরু করি। ২০১৩ সালে আমি ফাইবারের সাথে কাজ শুরু করেছি  এবং ২০১৬ সালে, আমি আমার প্রতিষ্ঠান ‘এবিসি থিম’ প্রতিষ্ঠা করেছি এবং এনভাটো মার্কেটে (থিমফোরেস্ট) প্রিমিয়াম ওয়ার্ডপ্রেস থিম বিক্রি করছি।’

আতিকুর রহমানের কাজ

আতিক ক্লায়েন্টদের জন্য, বিশেষত ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইটগুলির জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট তৈরি করেন এবং ওয়েবসাইট সম্পর্কিত সমস্যাগুলিও সমাধান করেন। ওয়ার্ডপ্রেস ছাড়াও, তার এইচটিএমএল৫, সিএসএস৩, জাভাস্ক্রিপ্ট, পিএইচপি, জেকুয়েরি ভাল দক্ষতা রয়েছে। তিনি এখন জাভাস্ক্রিপ্টের ইএ৬ শিখছেন। তিনি আপওয়ার্ক এবং ফাইবারে ৭৫০০টিরও বেশি প্রজেক্ট শেষ করেছেন। ফাইবারে তিনি আমাদের দেশের প্রথম শীর্ষ দুই ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে ছিলেন। এবিসি থিম প্রতিষ্ঠার পরে, তিনি ২০১৮-১৯ সালে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে আবার ২০১৯ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। ফাইবার ছাড়াও তিনি বর্তমানে আপওয়ার্কে শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কাজ করেন।

কেন ফ্রিল্যান্সিং?

আতিক বলেন যে তিনি ফ্রিল্যান্সিং পছন্দ করেছেন কারণ এই খাতে কাজ করা তাকে আনন্দ দেয়। তবে প্রথমে এটিকে নিজের ক্যারিয়ার বানানোর কোনও পরিকল্পনা তাঁর ছিল না, ধীরে ধীরে আরও উন্নতি করার পরে তিনি একে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় তিনি তার পরিবারের উপার্জনেও অবদান রাখতে চেয়েছিলেন। আতিক বলেন, ‘আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে ছিলাম, তখনই আমি মাসে ৭০ হাজার টাকা উপার্জন করছিলাম। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং ছাড়া চাকরির শুরুতেই কোনও কাজে এতো বেশি আয় করা সম্ভব না। তাই সর্বোপরি, কাজ, স্বাতন্ত্র্য এবং ভাল আয়ের জন্য আমি ফ্রিল্যান্সিংকে আমার ক্যারিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছি।’

যাত্রা কতটা কঠিন ছিল?

আতিকুরের শুরুটা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। ২০১০-১১ সালে এমন কোনও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল না যা থেকে কেউ ফ্রিল্যান্সিং শিখতে পারে। অনলাইন ডেটা এখনকার মতো সজ্জিত ছিল না। অনেকে প্রথমে বিষয়টি বিবেচনা করে নেননি। এত কিছুর পরেও তিনি নিজের কাজে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এবং কাজের জন্য আবেদন করেছিলেন। আতিকুর তার ইচ্ছা শক্তি, সততা এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করেছেন। এখন অবশ্যই এই পথটি অনেক সহজ হয়ে গেছে, বাংলাদেশ সরকার ফ্রিল্যান্সারদের পথ সহজ করার জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছে।

 

Atiqur Rahman

আতিকের অনুপ্রেরণা

তিনি বলেন, ‘আমার কোনও বিশেষ নাম মনে নেই, তবে সামগ্রিকভাবে, যখন আমি বিভিন্ন ব্লগে নিবন্ধগুলি পড়ি, ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখেছি, তাদের কথা শুনেছি, তাদের সাফল্য দেখেছি এবং নিজেকে অনুপ্রাণিত করেছি। আমার পরিবার সবসময় আমাকে একজন ফ্রিল্যান্সার হতে সহায়তা করেছে।’

আতিকুরের কাজের এলাকা

আতিক বর্তমানে আপওয়ার্ক এবং ফাইবারে ফ্রিল্যান্সার এবং থিমফোরেস্টে লেখক হিসাবে কাজ করছেন।

আপনি কীভাবে আপনার দক্ষতা বিকাশ করতে পারেন?

এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রতিদিন ২-৩ ঘন্টা নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি। আমি ইতিমধ্যে যে কোনও নতুন ওয়েব ভাষা, বা আমার পরিচিত বিষয়গুলির বুনিয়াদিগুলির উন্নত স্তরগুলি শিখতে চেষ্টা করছি। আমি মনে করি প্রতিটি ফ্রিল্যান্সারকে এই জিনিসগুলি অনুসরণ করা উচিত ”

ফ্রিল্যান্সার হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ দিকটি কী?

ফ্রিল্যান্সিং এর সমস্যার ক্ষেত্রে আতিক বলেন, ‘সমস্যাগুলি বেশিরভাগ ক্লায়েন্টদের কারণে ঘটে। আর মার্কেটপ্লেসগুলোও সাধারণত ক্লায়েন্টদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার সময় এই চ্যালেঞ্জগুলি বিবেচনা করা উচিত।’

ফ্রিল্যান্সিং এর সেরা বিষয় কী?

স্বাধীনতা এবং সাফল্য একজন ফ্রিল্যান্সারের আনন্দের মূল উত্স। আতিক বলেন, ‘আপনি যখন বাজারে শীর্ষে থাকবেন তখন কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ বাড়বে।’ আতিকুর ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারে শীর্ষে ছিলেন। তিনি প্রায় শতাধিক দেশের মানুষের সাথে কাজ করেছেন, এটি তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। স্বাধীনতার পাশাপাশি, সফল ফ্রিল্যান্সাররা দ্রুত আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে এবং সহজেই পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারে। আতিক ফ্রিল্যান্সিং এর অর্থ দিয়ে গত বছর ঢাকায় ১ কোটি টাকা দিয়ে একটি বিশাল ফ্ল্যাট কিনেছেন। 

ক্লায়েন্টকে খুশি রাখতে আতিকের ৩ পরামর্শ

ক্লায়েন্টদের খুশি রাখতে আতিক পরামর্শ দেনঃ

১) কাজ বুঝে কোনও কাজের জন্য আবেদন করা: আপনি কাজটি ভালভাবে করতে পারবেন এবং ক্লায়েন্টের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন – এই বিষয়টি নিশ্চিত করার পরে আপনাকে চাকরির জন্য আবেদন করতে হবে।

২) যোগাযোগ: ক্লায়েন্টদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, প্রতিদিনের কাজের আপডেটগুলি সরবরাহ করা এবং কাজটি কখন শেষ হবে তার ধারণা ক্লায়েন্টকে দেওয়া – এগুলো ভালো অভ্যাস। এগুলোর চর্চা করতে হবে।

৩) বিতরণ: সময়মতো কাজ সরবরাহ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনও প্রজেক্ট বেশি সময় নেয়, ক্লায়েন্টকে আগেই জানিয়ে দেওয়া উচিত এবং সময় বাড়ানো উচিত।

নতুনদের জন্য পরামর্শ

নতুন ফ্রিল্যান্সারদের প্রথমে ভয়- আমার কী হবে? আমি কি বাজারে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হব? আতিক নতুনদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার নিজের সম্পর্কে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আপনার পর্যাপ্ত কাজের দক্ষতা, ধৈর্য, ​​হাল না ছাড়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলে আপনি অবশ্যই বাজারে কাজ পাবেন’। এছাড়াও তিনি যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করারও পরামর্শ দেন।

ভবিষ্যতের জন্য আতিকের লক্ষ্য

কাজ করার পাশাপাশি আতিকুর দেশে ফ্রিল্যান্সারদের মান বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করার চেষ্টা করছেন এবং ভবিষ্যতেও এ কাজ চালিয়ে যাওয়ার আশা করছেন। তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে বিভিন্ন ভিডিও এবং তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট devatiq.com এ বিভিন্ন নিবন্ধ তৈরি করেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম এবং স্বীকৃত ফেসবুক গ্রুপ ‘ফাইভার হেল্প বাংলাদেশ’ এর সিনিয়র অ্যাডমিন। এই গ্রুপে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার সদস্য রয়েছে। প্রায় সমস্ত গ্রুপ সদস্য ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে জড়িত।

এই গ্রুপের উদ্যোগে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সাথে ফ্রিল্যান্সারদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে একটি সরাসরি অনলাইন প্রোগ্রাম হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ফাইবার অফিসিয়াল থেকে একটি ইভেন্টেরও আয়োজন করেন আতিক, সেখানে তিনি স্পিকার ছিলেন। আতিক বলেন, ‘ভবিষ্যতে, আমি আমার ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে অ্যাডভান্স ওয়েব ডেভলপমেন্ট কোর্স অফার করতে চাই। ভবিষ্যতে কিছু লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য একটি সফ্টওয়্যার ফার্ম আর একটি রেস্তোঁরা ব্যবসা দেবার ইচ্ছাও আছে।’

দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আজ আতিকুর রহমান একজন সফল ফ্রিল্যান্সার, যিনি বর্তমানে আরও কয়েক হাজারকে তাঁর মতো সফল হতে সহায়তা করছেন। তিনি শুধু নিজেই এগিয়ে যান নি। এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমাজকে। এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকে।