মো. শামীম সরদার একজন ওয়েবসাইট ডিজাইনিং ও ডেভেলপিং সেক্টরে কর্মরত ফ্রিল্যান্সার। নিজের দৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আজ তিনি একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। আমরা তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি তার এই জার্নির গল্প।
শুরুটা কখন ও কীভাবে হয়েছিলো?
শামীম কাজ শুরু করেন ২০১৩ এর দিকে। তিনি তখন লোকাল মার্কেট বা আসেপাশের পরিচিতদের কাছ থেকে কাজ নিতেন, কাজটা ছিলো মূলত ডাটা এন্ট্রির কাজ। তারপর তিনি কম্পিউটারে রিসার্চ শুরু করেন যে কীভাবে তিনি নিজেই ডাটা এন্ট্রির কাজগুলো পেতে পারেন। এবং এভাবেই পরিচিত হন ওডেস্ক বা বর্তমান আপওয়ার্ক এর সাথে। তিনি ওডেস্ক এ একটি প্রোফাইল খুলেন কিন্তু ওডেস্ক নিয়ে নলেজ ও অভিজ্ঞতা কম থাকায় তিনি কিছুদিন সেখানে কাজের চেষ্টা করেননি, পরবর্তীতে তিনি আবার ফিরে গিয়ে ওডেস্ক নিয়ে রিসার্চ করে জানতে পারেন এখানে কীভাবে কাজ করা হয়। তিনি তারপর জবের জন্য এপ্লাই করেন এবং কিছু এপ্লাইয়ের পর একটি রিসার্চ প্রজেক্ট পান। এই প্রজেক্ট এর আওয়ারলি রেট ছিলো খুবই কম, মাত্র টেন সেন্ট পার আওয়ার। এখান থেকেই তার কাজের শুরু।
কিছুদিন কাজ করে তিনি বুঝতে পারেন যে এই ধরনের কাজের মার্কেট ভ্যালু অনেক কম। তাই তিনি আরো ভালো কাজের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে রিসার্চ করে ওয়েব ডিজাইনিং ও ডেভেলপমেন্ট এর প্রতি ইন্টারেস্টেড হন ও এর উপর কোর্স সম্পন্ন করে পুণরায় ওডেস্ক এ ফিরে এসে ফ্রিলান্সার একাউন্ট খুলে জব শুরু করেন। এরপর থেকেই মূলত এই সেক্টরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি কী কাজ করেন?
শামীম মূলত ওয়েবসাইট ডিজাইনিং ও ডেভেলপিং নিয়ে কাজ করে থাকেন। এছাড়া যেকোন ধরণের ওয়েব বেসড এপ্লিকেশন নিয়েও কাজ করেন। ম্যাক্সিমাম ওয়ার্ক করে থাকেন আপওয়ার্ক থেকে। আর বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট ইউএসএ থেকে তারপর ইউকে ও অন্যান্য দেশ থেকে পেয়ে থাকেন। তাছাড়া তিনি লোকাল মার্কেটেও কিছু কাজ করেন।
ফ্রিল্যান্সিংই কেনো?
শামীম মনে করেন ফ্রিল্যান্সিং এর কারণে তিনি অর্থ উপার্জনই না, নিজেকে অনেকটা ডেভেলপ করতে পেরেছেন। তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন এইচ এস সি এক্সাম এর পরে। ২০১৩–১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি নিজেকে অনেকখানি বদলাতে পেরেছেন।
দ্বিতীয় যে সুবিধাটি তিনি পান তা হলো কাজের স্বাধীনতা। তিনি কাদের সাথে কাজ করবেন বা কখন কাজ করবেন ও কীভাবে করবেন এ বিষয়ে তিনি একটি প্ল্যান করে এগুতে পারেন। টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে পারেন। এর মাধ্যমে তৃতীয় আর শামীমের নিকট সবচেয়ে বড় সুবিধা তিনি মনে করেন যে, কাজ নিজের সুবিধা মতো নেয়ার কারণে তিনি নিজের জন্য সময় বের করতে পারেন। শামীম ট্রাভেলিং পছন্দ করেন। তিনি দু এক মাস পর পরই ঢাকার বাইরে গিয়ে ঘুরে আসেন। বিভিন্ন মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারেন। ওভারঅল ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে তিনি একটা স্বাধীনতা পাচ্ছেন৷ তবে তিনি এও বলেন যে, এই স্বাধীনতা ফ্রিল্যান্সার হওয়ার সাথে সাথেই পাওয়া যায় না। বেশ কয়েক বছরের পরিশ্রমের পর তিনি এটা অর্জন করতে পেরেছেন।
জার্নিটা কতো কঠিন ছিলো?
শামীমের শুরুটা বেশ কঠিনই ছিলো। তিনি যখন শুরু করেন তখন এ বিষয়ের উপর ওপেন প্লাটফর্মগুলোতে রিসোর্স খুবই কম ছিলো যেখান থেকে তিনি শিখতে বা জানতে পারেন। তার সাথে তার নিজের স্কিলও কম ছিলো, এবং তিনি কোন গাইডও পাচ্ছিলেন না। এজন্য একবার তিনি ফ্রিল্যান্সিং এ সাকসেসফুলি দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও কিছু সময় সারভাইভাল পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যান, তার ইনকাম কমে গিয়ে প্রায় জিরোতে চলে আসে। এর কারণ ছিলো তিনি কাজের পাশাপাশি স্কিল ডেভেলপমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছিলেন না এবং এ বিষয়ে তিনি কোন গাইডও পাননি।
এছাড়া ইংলিশ ল্যাগুয়েজ এ স্কিল কম থাকায়ও একটি সমস্যার মুখোমুখি হন। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিং এর জগতের মানুষের সাথে পরিচিতি কম থাকায় মোটিভেশন ধরে রাখাও একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো তখন। তিনি তারপর এইসকল চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলো আস্তে আস্তে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
ফ্রিল্যান্সিং এ ইন্সপায়ারড করেছেন এমন কেউ কি আছেন?
শামীম প্রথম থেকেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিজে নিজে মোকাবিলা করে নিজেকে ডেভেলপ করেছেন। তিনি সেই চ্যালেঞ্জগুলোকেই নিজের ইন্সপায়ারেশন ও মোটিভেশন হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যেভাবেই হোক তার নিজের স্কিল ডেভেলপ করা অত্যন্ত জরুরি একটা স্টেবল মার্কেটপ্লেস পজিশনের জন্য। এছাড়া তিনি সবসময়ই কম্পিউটারের কাজ সমুহের দিকে কৌতূহলী ছিলেন। মূলত নিজের কিউরিওসিটি, উইল পাওয়ার ও ভালোলাগা থেকেই ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ এর জন্য অনেক চ্যালঞ্জ এর মধ্য দিয়েও নিজেকে তৈরি করে নেন।
এছাড়া শামীম এর নিজের কম্পিউটার ছিলো না যেটা দিয়ে তিনি রিসার্চ করতে পারেন। তিনি তার আগের অফিসের অফিস আওয়ারের প্রায় এক ঘন্টা আগে প্রতিদিন পৌঁছে যেতেন এবং অফিস শুরু হওয়ার আগের সময়টাকে কাজে লাগিয়ে এসব নিয়ে রিসার্চ করতেন। ক্লিপ, পেপারক্লিপ এধরনের বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কাজ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন। এটিও একটি অনেক চ্যালেঞ্জিং সময় ছিলো। পুরোটা সময় তিনি নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন এবং হাল ছাড়েননি কাজের প্রতি।
বর্তমানে তিনি কোন মার্কেটপ্লেস এ কাজ করছেন?
তিনি মূলত এখন আপওয়ার্ক এ কাজ করেন। আপওয়ার্কের আগে তিনি ইল্যান্স(পরবর্তীতে আপওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়) ও ফ্রিল্যান্সার এও কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি লোকাল মার্কেটেপ্লেস থেকেও কাজ নিয়ে থাকেন।
তিনি কীভাবে তার স্কিল ডেভেলপমেন্ট করে থাকেন?
শামীম মনে করেন তার সেক্টরে বিভিন্ন ধরণের স্কিল বাড়িয়ে তোলা ও নতুন নতুন স্কিল শেখার কোন বিকল্প নেই। তিনি প্রতিদিনই কাজের ভিতর দিয়েও অনেক কিছু শেখেন। প্রত্যেক প্রজেক্ট এ কিছু চ্যালেঞ্জিং পার্ট থাকে, সেটা নিয়ে রিসার্চ করে শিখতে পারেন আর পরবর্তীতে আরো ডেভেলপ করতে পারেন।
এছাড়া তিনি প্রতি তিনমাসে ৭–১০দিন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ফোকাস করেন। সেই টপিকটায় স্কিল ডেভেলপমেন্ট করার কাজ করেন। তিনি মনে করেন প্রত্যেক ফ্রিল্যান্সারেরই নিজের সেক্টর সম্পর্কে নতুন নতুন স্কিল অর্জন করার ও আগের জানা বিষয়গুলোতে আরো এক্সপার্ট হওয়া অনেক এসেনশিয়াল একটি বিষয়। কারণ প্রতিনিয়তই নতুন নতুন টেকনলোজি আসে। এভাবেই মূলত তিনি জাভাস্ক্রিপ্ট, সিএসএস, পিএইচপি ইত্যাদি শিখেছেন। নতুন নতুন টেকনলোজির সাথে আপডেটেড থাকা জরুরি।
ফ্রিল্যান্সিং এর সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো কী ছিলো?
শামীমের মতে ফ্রিল্যান্সিং এর মেইন খারাপ দিক দুধরনের, ফাইনান্সিয়াল ও পার্সোনাল লাইফ ম্যানেজমেন্ট। ফ্রিল্যান্সিং এ যেহেতু কাজের ভিত্তিতে পেমেন্ট তাই অনেক সময়ে মাসে সমান পরিমান উপার্জন নাও আসতে পারে। এর কারণে বিভিন্ন সময়ে একটু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তবে বেটার প্ল্যানিং এর মাধ্যমে এটি ওভারকাম করা সম্ভব।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি হলো কাজের স্বাধীনতা থাকার কারণে ও ক্লায়েন্টদের সাথে টাইমজোনের পার্থক্য থাকার কারণে অনেক সময় পার্সোনাল লাইফের ছন্দপতন ঘটে। অনেকে রাতে কাজ করে ও রুটিন ওলট–পালট হয়ে যায়। এটি সাময়িক ভাবে তেমন ক্ষতি না করলেও লং রানে অনেক ক্ষতি করে। এটিও ওভারকাম করা সম্ভব তিনি বলেন৷ কাজ ও পার্সোনাল লাইফের জন্য একটি নির্দিষ্ট রুটিন বা প্ল্যানিং করে এগিয়ে যেতে থাকলে এই সমস্যা অনেকটাই কমে যায়।
ফ্রিল্যান্সিং এর সবচেয়ে ভালো দিক কোনটি?
ভালো দিক তিনি বেশ কয়েকটির কথা বলেন। কাজের স্বাধীনতা, আরনিংস, নিজের ও ফ্যামিলির জন্য সময় বের করতে পারা এসব কিছু নিয়ে তিনি ফ্রিল্যান্সিং লাইফ এ অনেক স্যাটিসফাইড যা তার মতে, হয়তো অন্য কাজে পেতেন না।
ফ্রিল্যান্সিং এর তিনটি টিপস?
তার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হচ্ছে-
১. যে কাজ নিয়ে আপনি কনফিডেন্ট যে আপনি করতে পারবেন সে কাজটিই নিন: কখনোই আপনি সংশয় এ থেকে কাজ নিবেন না। আপনি ক্লায়েন্টকে গ্যারান্টি দিতে পারবেন যে আপনি তার কাজটি শেষ করতে পারবেন তবেই সেই কাজটি নিন।
২. কখনোই রিকোয়ার্ড কাজের চেয়ে কম দিবেন না, চেষ্টা করবেন একটু বেশি দেয়ার জন্য: নির্ধারিত কাজের চেয়ে একটু বেশি দিলে ক্লায়েন্ট খুশি হবে এবং আপনার কাছে পুনরায় কাজের জন্য আসবে। আপনার ভাগ্য ভালো হলে আপনি কিছু বোনাস ও পেতে পারেন৷ আপনার রেটিং ও বাড়বে। তাই চেষ্টা করবেন নির্ধারিত কাজের চেয়ে একটু বেশি দিতে।
৩. ডেডলাইনের মধ্যে কাজ শেষ করা: অবশ্যই ডেডলাইনের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করবেন। অথবা আপনি ক্লায়েন্টকে বুঝিয়ে হাতে ২/১দিন সময় বেশি নিয়ে রাখবেন যাতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হলেও আপনি ঝামেলায় না পড়েন। আর সম্ভব হলে টাইম শেষের আগেই কাজ দিয়ে দিন।
নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কিছু কথা?
নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলতে চান যে, প্রথমেই অবশ্যই স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর দিকে নজর দিতে হবে। নিজেকে যত পারা যায় স্কিল্ড ওয়ার্কার করতে হবে। আর প্রথমদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হবে তাতে হাল ছাড়া যাবে না। ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে ভালো ধারণা নিতে হবে, প্ল্যাটফর্ম, কীভাবে কাজ হয় ইত্যাদি বেসিক তো অবশ্যই রাখতে হবে। আর অবশ্যই পার্সোনাল লাইফের দিকেও নজর দিতে হবে। ফিজিক্যালি ফিট থাকতে হবে রুটিন লাইফ করে।
ভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা করছেন?
শামীম এর মতে তিনি এখনো অনেককিছু শিখতে পারেন। তিনি তাই নিজেকে আরো স্কিল্ড করে ভবিষ্যতে আরো সফল হতে চান। এর জন্য তিনি বিভিন্ন লং টার্ম স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং করেছেন। তিনি এখন এই লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চান। তো এই ছিলেন মো. শামীম সরদার, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দৃঢ় মনোবল দিয়ে আজ একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। তার মতে সকলের উচিত সফল ব্যক্তিদের পাশাপাশি ব্যর্থ ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা নিয়েও সকলের জানা উচিত। এভাবে বিগ পিকচার টা বোঝা যায় সেটা যে সেক্টরই হোক। এ থেকেই ধারণা পাওয়া যায় তার অধ্যাবসায়ের ও ইনসাইটের, যিনি ভবিষ্যতে নিজেকে আরো ভালো করতে বিশ্বাসী।