আজকে বলবো ১৬ বছর বয়সের এক কিশোর ছেলের কথা যার নাম সোলায়মান হায়দার,  যিনি একজন সফল ফ্রিলান্সার । যিনি তার মায়ের মুখে হাসি দেখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন ।  যিনি ১৬ বছর বয়সে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখেছেন এবং যিনি দীর্ঘ ১০ বছর যাবত ফ্রিলান্সিং করছেন বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে এবং নন-মার্কেট প্লেসে । আজকে আমরা তার কাছ থেকে শুনব তার এই দীর্ঘ ১০ বছরের ফ্রিল্যান্সিং জার্নি সম্পর্কে অজানা কিছু  কথাঃ

ফ্রিল্যান্সিং এর শুরুর দিকের কিছু গল্প 

আমার অনেকগুলা শখের মধ্যে একটা হলো ব্লগিং। ব্লগিং করার জন্য আমি বিভিন্ন ফ্রি টেম্পলেট ব্যবহার করে ব্লগ ডিজাইন করতাম। আমি বরাবরই ব্লগ ডিজাইনের প্রতি খুঁতখুঁতে ছিলাম। এক টেম্পলেটের একটা ফিচার পছন্দ হলে, আরেকটা হতো না। কিন্তু আমি চাইতাম আমার ব্লগের ডিজাইনটি হোক একটি সেরা ডিজাইন। সেখান থেকেই মাথায় বুদ্ধি আসলো ডেভেলপার দিয়ে ব্লগ ডিজাইন/ডেভেলপ করার টাকা যেহেতু নেই, সেহেতু নিজেই ডেভেলপার হয়ে যাই। সেই চিন্তা থেকেই প্রোগ্রামিং এর লাইনে আসা। এই লাইনে আসার পরে দেখলাম ব্লগিং না, প্রোগ্রামিং ই আমার প্যাশন। প্রোগ্রামিং সেক্টরেই আমার ক্যারিয়ার গড়া উচিত। সেই থেকেই প্রোগ্রামিং এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের সাথে আমার পথচলা শুরু। আমার প্রথম প্রফেশনাল ওয়েব ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট পাই ২০১১ সালে ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক)। এরপর থেকে একেরপর এক ওয়েব ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট করেই চলেছি গত ১০ বছর ধরে।

আপনি কি ধরনের কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

আমি মূলত ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার, ফ্রন্ট-এন্ড এবং ব্যাক-এন্ড ওয়েব দুইটাই ডেভেলপ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে কিছুদিন ধরে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি আইওএস এবং ম্যাকওএস এপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। সত্যি বলতে প্রোগ্রামিং সকল সেক্টরের কাজ করতেই আমার ভালো লাগে। চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্টগুলোতে বেশী মজা পাই। চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্টগুলোতে নতুন কিছু বিষয় শেখা হয়ে যায়, এটা ভালো লাগে। 

ওয়েব ডেভেলপমেন্টে ফ্রিল্যান্সার হওয়ার জন্য কোন কোন দক্ষতা প্রয়োজন হতে পারে?

ওয়েব ডেভেলপমেন্ট অনেক বড় একটা টপিক। ওয়েব ডেভেলপমেন্টে অসংখ্য সেক্টর আছে আবার সেগুলোর আবার প্রচুর সাব-সেক্টর আছে। সো, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখার জন্য আপনাকে আগে ঠিক করতে হবে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কোন সেক্টরে কাজ করতে চান আপনি। ধরে নিচ্ছি আমি যা করি কেউ যদি এরকম ওয়েব ডেভেলপার হতে চায়, তাহলে তাকে শিখতে হবে PHP, MySQL, JavaScript এবং অবশ্যই HTML ও CSS. এর সাথে কোন একটা পিএইচপি ফ্রেমওয়ার্ক শিখতে হবে যেমন, ল্যারাভেল। তাছাড়া ওয়েব ডেভেলপমেন্টের একটি বড় অংশ হলো ওয়েব সার্ভার। সো, প্রত্যেক ওয়েব ডেভেলপারের লিনাক্স এবং সার্ভার ম্যানেজমেন্ট জ্ঞান থাকা উচিৎ।

কেন ফ্রিল্যান্সিং কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছেন?

সোলায়মান হায়দারআগেই বলেছি আমি প্রোগ্রামিং ভালোবাসি। আমি প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা কোড করতে পারি এবং এতে বিরক্ত লাগে না। আমি বুঝে গিয়েছিলাম যদি ভালোবাসি এমন কোন ক্যারিয়ার পছন্দ করতে হয় তাহলে সেটা প্রোগ্রামিংই হতে হবে। আমি যখন প্রোগ্রামিং শুরু করি তখন আমি ছিলাম টিনএজ একটা কিশোর। তখন বাংলাদেশে প্রোগ্রামিং এর প্রচুর জব ছিল না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো, কোন কোম্পানি ১৬ বছর বয়সী একটা ছেলেকে প্রোগ্রামার হিসেবে চাকরি দিবে না। সুতরাং সেরা অপশন ছিল ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলো। সহজেই প্রজেক্ট খুঁজে পাওয়া যেতো, বাড়ি থেকে কাজ করা যায় এবং আপনি কে ও আপনার বয়স কত তা  ক্লায়েন্টরা কেয়ার করে না,  স্কিল দিয়ে ক্লায়েন্ট কে সন্তুষ্ট করতে পারলে ক্লায়েন্ট আর কিছু দেখে না। কয়েকবছর ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডেভেলপমেন্ট করার পর বুঝলাম যে আমি যেরকম সুযোগ-সুবিধা এবং আয় করছি ফ্রিল্যান্সিং করে সেটা রেগুলার অফিস জবে অসম্ভব। তাই অফিস জবে মুভ না করে ফ্রিল্যান্সিং এ ই থেকে গেলাম। 

আপনার ফ্রিল্যান্সিং জার্নিটা কেমন ছিলঃ

যারা ২০১১ অথবা তার আগে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছে, বিলিভ মি তাদের জার্নিটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। বিশেষ করে যারা আমার মতো ছোট শহর বা গ্রাম থেকে ফ্রিল্যান্সিং এ এসেছি, আমাদের প্রতি সেকেন্ডে স্ট্রাগল করতে হতো। ইন্টারনেট বলতে ছিল GPRS বা ২জি ইন্টারনেট। গ্রামে বা মফস্বলে তো ব্রডব্যান্ড এর নামও কেউ জানতো না তখন। আর কাজ শেখার জন্য রিসোর্সও ছিল না তেমন। রিসোর্স বলতে বিদেশি ইন্সট্রাক্টরদের ব্লগ এবং ইউটিউব ভিডিও ছিল একমাত্র সম্বল। ইউটিউব এর ভিডিও দেখা ছিল আরেক চ্যালেজ। ১০ মিনিটের একটা ভিডিও দেখার জন্য ওপেন করে কয়েক ঘণ্টা রেখে দিতাম বাফার হওয়ার জন্য। আর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে ছিল লোডশেডীং। আমি অসংখ্য প্রজেক্ট হারিয়েছি শুধুমাত্র লোড-শেডিং এর জন্য। 

আমি অত্যন্ত গরীব ঘর থেকে এসেছি। আমাদের নিজেদের কোন বাড়ি ছিলো না তখন। ১৫০০ টাকা ভাড়ার দুই রুমের টিনশেড বাসায় থাকতাম আমরা। আমার আর আমার ছোট ভাইয়ের জন্য যে রুমটা ছিলো সেটা অনেকটা গ্রামের বাড়িগুলার মুরগির খোপের সাইজের। এই মুরগির খোপই ছিলো আমার প্রোগ্রামিং ক্যারিয়ারের আঁতুড়ঘর। এই ঘরে জুলাইয়ের গরমের রাতে ফ্যান ছাড়া ছোট ভাই ঘুমাতো আর আমি সারারাত পরে থাকতাম কম্পিউটার নিয়ে প্রোগ্রামিং শেখার নেশায়।

আপনার কাজের পেছনে অনুপ্রেরণা কার?

আমার মা। নির্দিষ্ট কোন টেক পার্সনের কাছে আমি অনুপ্রেরণা পাই নি। আমার সকল সফলতার ক্রেডিট আমার মায়ের। যে ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সে ঘরে ধার করে কম্পিউটার কিনে দেয়ার দুঃসাহস করেছিলো আমার মা। আমি কাজ শেখার সময়টুকুতে যতবার আমার মায়ের মুখ দেখেছি ততবারই নতুনভাবে কঠোর পরিশ্রম করার অনুপ্রাণিত হয়েছি। শুধুমাত্র আমার মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য আমাকে সফল হতে হবে এরকম একটা জিদ চেপে গিয়েছিলো আমার মনে। আমার মায়ের অনুপ্রেরণা না পেলে স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঘরে ভ্যাপসা গরমে আমি দৈনিক ১৬-১৭ ঘণ্টা কম্পিউটার নিয়ে পরে থাকতে পারতাম না। 

মহান আল্লাহ তায়লার কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আমি সফল হতে পেরেছি। মায়ের মুখের হাসিই আমার কাছে সফলতা। আমার মায়ের প্রত্যেকটা হাসি আমি এক একটি এচিভমেন্ট হিসেবে মনে করি।  

আপনি কোন মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন?

আমি প্রথম থেকেই আপওয়ার্কে (তৎকালীন ওডেস্ক) কাজ করি। এর মাঝে পিপল পার আওয়ার লঞ্চ হওয়ার পর বছরখানেক সেখানে কাজ করেছিলাম। গত কয়েকবছর ধরে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে অনিয়মিত হয়ে পরেছি। ক্যালিফর্নিয়ার একটা কোম্পানিতে ফুল-টাইম সিনিয়র ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছি। অফিস টাইমের বাইরে কয়েক ঘণ্টা ফ্রিল্যান্সিং করা হয় এখন। আর বর্তমানে আমার বেশীরভাগ কাজ পুরাতন ক্লায়েন্ট, ক্লায়েন্টের রেফারেন্সে, ব্লগস, ইত্যাদি মাধ্যমগুলো থেকে আসে। 

তাছাড়া এখন ইউএস এ তে নিজের বিজনেস সেটআপ নিয়ে কাজ করছি। খুব শীঘ্রই সকল কাজ আমার কোম্পানির ব্যানারে নিয়ে যাবো। আর সার্ভিস বেজড বিজনেস মডেল থেকে বের হয়ে এসে প্রোডাক্ট এবং সাবস্ক্রিপশন বেজড বিজনেস মডেলে মুভ করার চেষ্টায় আছি।

আপনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, ক্লায়েন্টকে খুশি  রাখতে ৪ টিপস শেয়ার করুন

১. প্রোফেশনাল হোনঃ আপনি আপনার কাজের জন্য টাকা নিচ্ছেন, সো সবসময় আপনার সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করুন।

২. রিস্পন্সিভ হোনঃ যোগাযোগ ফ্রিল্যান্সিং এর অনেক গুরুত্বপুর্ন একটা বিষয়। সবসময় নির্দিস্ট টাইমে এভাইলেবল থাকুন। 

৩. সময়মতো প্রজেক্ট শেষ করুনঃ সময়মতো প্রজেক্ট ডেলিভারি করতে পারাটা অনেক গুরুত্বপুর্ন। সবসময় চেষ্টা করুন ডেডলাইনের আগেই প্রজেক্ট ডেলিভারি করতে।

৪. পুরাতন ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ রাখুনঃ প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পরও ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। পুরাতন ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্রচুর কাজ পাওয়া যায়। 

নবাগতদের জন্য কয়েকটি টিপস

নতুন যারা ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে আসছেন তাদের একটা কথা ই বলবো যে, আগে কাজ শিখুন। অনেকের মনে একটা ভুল কনসেপ্ট থাকে যে, ফ্রিল্যান্সিং টাকা ইনকামের সহজ রাস্তা। এটা বিশ্বাস করে ফ্রিল্যান্সিং করতে আসলে আপনি আশাহত হবেন। অন্য যেকোন জবের চেয়ে এই সেক্টরটা বরং কঠিন। আপনার দক্ষতা না থাকলে আপনি এখানে সার্ভাইভ করতে পারবেন না। কাজ শিখে আসুন এবং কাজ শিখতেই থাকুন। শেখার কোন শেষ নেই, প্রতিনিয়ত টেকনোলোজি আপডেট হচ্ছে, তাই প্রতিনিয়ত আপনার স্কিল আপডেট করুন। আর অবশ্যই কমিউনিকেশন স্কিলে নজর দিন, প্রজেক্ট জিতে নেয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন স্কিল অনেক গুরুত্বপুর্ন রোল প্লে করে। সবশেষে বলবো, ক্লায়েন্ট আপনাকে পে করছে, সো আপনার স্কিলের সেরাটা দিন ক্লায়েন্টকে এবং টাইমলি প্রজেক্ট ডেলিভার করুন।