ফ্রিল্যান্সিং জগতের নানামুখী ক্যাটাগরির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ওয়েব ডেভেলপমেন্ট। কোডিং আর লজিকের সংমিশ্রণে নতুন প্রোগ্রাম বা সাধারণ ওয়েবসাইট তৈরি; ওয়েব ডেভেলপমেন্টে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজের সুযোগ। কিন্তু অন্যান্য সব সেক্টরের মত এখানেও নতুনদের কাজ পেতে তুমুল প্রতিযোগিতা।

আশার কথা হল, আজকাল সাধারণের মধ্যেও ওয়েবসাইট তৈরির চাহিদা হওয়ায় এক্ষেত্রে বেড়েছে কাজের সুযোগ। 

ইউএস লেবার ব্যুরোর পরিসংখ্যানে ২০১৬ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের চাহিদা আরো ১৫% বাড়ছে!

লইয়ার (lawyer), ফটোগ্রাফার (Photographer), মার্কেটার বা মিউজিশিয়ান; এসব ক্রিয়েটিভ পেশাতেও এখন ওয়েবসাইট থাকা প্রয়োজনীয়। আর ওয়েব ডেভেলপাররা সবধরনের বিজেনেসকে অনলাইন প্রেজেন্সে সার্ভিস দেয়ার ইউনিক অবস্থানে থাকায় এ সেক্টরের গ্রোথ ঊর্ধ্বমুখী।

ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কাদের জন্য উপযুক্ত

সাধারণ ওয়েবসাইট বানিয়ে হাজার ডলার উপার্জন শুনতে সহজ মনে হলেও, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট আসলে সবার জন্য না। এ সেক্টরের চ্যলেঞ্জগুলো জানার আগে জেনে নেয়া যাক পজিটিভ দিকগুলো কি-

#ওয়েব ডেভেলপমেন্ট মূলত ক্যারিয়ারমুখি জব। এখানে নতুন বা বিগিনার ফ্রিল্যান্সারদের যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি এক্সপার্টদের জন্য অধিক উপার্জন সহ সিকিউর ক্যারিয়ার তৈরির সুবিধা।

# ডেভেলপমেন্টে দক্ষ হলে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হওয়া

# এবং কোডিং বা ডেভেলপমেন্টে সাক্সেস্ফুল ক্যারিয়ার তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী গুরুত্ববহ না। ইন্টারনেট সংযোগসহ ভাল একটি কম্পিউটার, এবং কঠোর পরিশ্রম সহ শেখার যোগ্যতা থাকা সবচে গুরুত্বপূর্ণ।

চ্যালেঞ্জগুলো কি কি

# ওয়েব ডেভেলপমেন্টের বেসিক জিনিস শিখতে সময়, ধৈর্য এবং নিয়মিত প্র্যাকটিস প্রয়োজন

# ফ্রিল্যান্স বিজনেসে প্রজেক্ট ম্যানেজ করা কঠিন

# ক্লায়েন্ট স্যাটিসফেকশন ধরে রেখে নিয়মিত কাজ করা অন্যতম আরেকটি চ্যালেঞ্জ 

উপার্জনের সুযোগ কেমন?

ইউএস নিউজ এবং গ্লাসডোরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডেভেলপারদের গড় স্যালারি বছরে ৳৬৯,০২২ ডলার। যেখানে, মোটামুটি দক্ষতার ফ্রিল্যান্সাররা ৳৫০,৯৯০ আর হাইলি স্কিলড হলে ৳১০০০০০ স্যালারি চার্জ করে!

যদিও স্কিল, লোকেশন আর এভারেজ ক্লায়েন্ট বাজেটে আয় অনেকটাই নির্ভর করে। তবে সবক্ষেত্রেই যোগ্যতাসম্পন্ন ডেভেলপারদের সম্ভাবনা বেশি।

ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ক্যাটাগরি

ওয়েব ডেভেলপমেন্টকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হয়।

১) ফ্রন্ট -এন্ড ডেভেলপমেন্ট

ফ্রন্ট -এন্ডে মূলত ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যারের  ডিজাইন অর্থাৎ লুক এন্ড ফিল নিয়ে কাজ করা হয়। সাইটের ইউআই, ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশন কেমন হবে তা নিয়ে ফ্রন্ট এন্ড  ডিজাইনাররা কাজ করে থাকেন।  ক্যাটাগরিতে কোয়ালিটি গ্রাফিক ডিজাইন স্কিল সহ এডোবি ফটোশপ (Adobe Photoshop), ইলাস্ট্রেটর (Illustrator), স্কেচ (Sketch) ইত্যাদি টুলসএর ব্যবহার প্রয়োজন।

২) ব্যাক-এন্ড ডেভেলপমেন্ট

সাইট স্ট্রাকচার, কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট, সারভার ম্যানেজমেন্টের মত জটিল বিষয় নিয়ে ব্যাক-এন্ড ডেভেলপমেন্ট। বিশাল ডেটাবেজের সার্ভিস ওয়েবসাইট, কোর্সেরা (Coursera) বা হেলথলাইনের মত মিলিয়ন ইউজারের সাইটের স্মুথ পারফর্মেন্সের জন্য নিয়মিত আপডেট,মেইনটেনেন্স এবং সিকিউরিটি ঠিক রাখার জন্য ব্যাক-এন্ডে রেগুলার কাজ করতে হয়। ব্যাক-এন্ডে কোডিং ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি, সাইট সংক্রান্ত ক্রিটিকাল ইস্যু সমাধানের দক্ষতা, এবং হাই ফাংশনালিটি প্রোডাক্ট তৈরি করার সক্ষমতা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। 

৩) ফুল স্ট্যাক ওয়েব ডেভেলপার

ফ্রন্ট -এন্ড আর ব্যাক-এন্ড দুইটা নিয়েই ফুল স্ট্যাক ডেভেলপমেন্ট। এখানে ইউয়াই (UI), ইউএক্স (UX) , ডাটাবেজ (Database), কোর ডেভেলপমেন্ট(Core Development) অর্থাৎ ওয়েবসাইটের মোটামুটি সব দিক অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে সব মার্কেটপ্লেসে ফুল স্ট্যাক ফ্রিল্যান্স ডেভেলপারদের চাহিদা  বেশি।

আবার স্কিল আর কোডিং এক্সপিরিয়েন্সের ভিত্তিতে ৩শ্রেণীর ডেভেলপার তৈরি হয়।

#লেভেল-১ঃ এই ধাপের একজন ডেভেলপার ওয়ার্ডপ্রেস (WordPress), উইক্স (WIX) ইত্যাদি কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ওয়েবসাইট তৈরি, ডিজাইন বা কাস্টমাইজ করতে দক্ষ।

#লেভেল-২ঃ মোটামুটি মানের দক্ষ হলে জাভাস্ক্রিপ্ট (JavaScript) ফ্রেমওয়ার্ক (Framework) ও অন্যান্য স্ক্রিপটিং ল্যাঙ্গুয়েজে  কাজের দক্ষতা থাকে।

#লেভেল-৩ঃ স্কিলড ডেভেলপাররা অবজেক্টিভ সি+ (C+), সি শার্প (C#), পাইথন (Python), রুবি (Ruby), এসকিউএল (SQL) ইত্যাদি কোর ডেভেলপমেন্ট এবং ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্টের মত জটিল বিষয়গুলোতে পারদর্শী।

তবে  লেভেল-১ ক্যাটাগরির স্কিল নিয়ে  ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মত কম্পিটিটিভ ফিল্ডে ফ্রিল্যান্সিং বিজনেসে সফল হওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।

শুরু করবেন কিভাবে

ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মেরুদণ্ড বলা হয় এইচটিএমএল (HTML) এবং সিএসএস (CSS) -কে। এবং এগুলা শেখাও সহজ। মাত্র মাসখানেক সময় দিয়েই ভালমত শেখা সম্ভব। এইচটিএমএল, সিএসএস দিয়েই যেকোনো বেসিক ওয়েবসাইট তৈরি করা যায়। তবে কমপ্লেক্স ফাংশনালিটির জাভাস্ক্রিপ্ট শেখা বেশ কঠিন। আবার রুবি অন রেইলস, মাইএসকিউএল (MySQL), বা পিএইচপির (PHP) মত সার্ভার সাইড ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতে চাইলে কন্টিনিউয়াস প্র্যাকটিস প্রয়োজন। 

কি ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন

একজন ভালমানের ওয়েব ডেভেলপার হতে হলে নিচের বিষয়গুলোতে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা আবশ্যক:

*জাভাস্ক্রিপ্ট, বুটস্ট্রাপ (Bootstrap) (জেকুয়েরি বা ভ্যানিলা জেএস)

* দ্রুপাল (Drupal), জুমলা (Joomla), হাবস্পট (Hubspot), ওয়ার্ডপ্রেস (WordPress) কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম

* আরএসএস (RSS) এবং মেইলিং লিস্ট( ওয়েবার, মেইলচিম্প, ফিডবার্ণার ইত্যাদি)

* সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট

* অন্তত একটি সার্ভার-সাইড ল্যাঙ্গুয়েজ সম্পর্কে ভালমত জানা 

* ডাটাবেজ কিভাবে কাজ করে তার পূর্ণ ধারণা থাকা

টেকনিক্যাল নলেজ যেমন অত্যাবশ্যকীয়, তেমনি ডেভেলপার হতে গেলে প্রয়োজন মার্কেটিং নলেজ সহ গুরুত্বপূর্ণ  সফট স্কিল থাকা। ফ্রিল্যান্স ডেভেলপমেন্টে  নিচের ৬টি ধাপ অনুসরন করে গড়ে তুলুন ওয়েবের সফল ক্যারিয়ার।

নিশ ঠিক করা

ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট শুরু করার আগে সবচে বেস্ট হচ্ছে কোন ল্যাঙ্গুয়েজ বা সেকশনে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য তা বের করা। ফ্রন্ট, ব্যাক না ফুল স্টাক ডেভেলপমেন্ট? এবার দেখুন আপনার দক্ষতা কোন পর্যায়ে? যদি আগে থেকেই কোডিং নলেজ থাকে তাহলে এডভান্স লেভেলের কাজ শেখা। আর যদি একদম নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে অফলাইন কোডিং বুটক্যাম্প, কোডএকাডেমী, ফ্রিকোডক্যাম্প ইত্যাদি অনালিন প্লাটফর্ম ব্যবহার করেও শিখতে পারেন। 

সুইফট, নড জে এস, বুটস্ত্র্যাপ ইত্যাদি কোডিং ল্যাঙ্গুয়েজে পারদর্শী ডেভেলপারদের মার্কেট চাহিদা বেশি। তাই শুরু করতে পারেন যে কোন একটা নিশ নিয়ে। নতুনদের জন্য পাইথন শেখা সহজ আবার ডিমান্ডেও আছে। 

শুরু করুন ডেভেলপমেন্ট

পছন্দের নিশ বের করার পর এবার কাজ তৈরি করা। অর্থাৎ, আপনি যা শিখছেন তা ব্যবহার করে নতুন কিছু বানানো। এইচটিএমএল, সিএসএস ব্যবহার করে পোর্টফলিও ওয়েবপেজ তৈরি। এছাড়া জাভাস্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে সাধারণ ক্যালকুলেটর, মজার স্নেক গেমস বা পার্সোনাল রিডার ইত্যাদি ছোটোখাটো প্রজেক্ট করতে পারেন। এতে যেমন নিজের কনফিডেন্স বাড়বে তেমনি কোডিং শেখার নিরস জার্নিও হবে উপভোগ্য। এছাড়া নিজের আইডিয়া ডেভেলপমেন্ট, প্রবলেম সলভিং নলেজ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।  

পোর্টফলিও

 ফ্রিল্যান্স বিজনেসের অন্য যে কোন সেকশনের মত ওয়েব ডেভেলপমেন্টে পোর্টফলিও থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পোর্টফলিওকে অনলাইন সিভি বলা হয়।আপনি ভাল কাজ পারেন বা বিশেষ কোন প্রজেক্টের রেফারেন্স দেয়া, সবকিছুর ওয়ান হ্যান্ড সল্যুশন বলা যায়। আবার ক্লায়েন্ট খুঁজে পাওয়া, প্রজেক্টে কনভিন্স করা এবং লেটেস্ট টেকনোলোজির সাথে নিজেকে আপ টু ডেট রাখার সবচেয়ে ভাল উপায় পোর্টফলিও। 

পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আপনাকে নিয়মিত পোর্টফলিও আপডেট, এডিট এবং ডেভেলপ করতে হবে। ফ্রিল্যান্স বিজনেসে ভালমানের পোর্টফলিও থাকা মানে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রিল্যান্সারদের চেয়ে কয়েকগুণ এগিয়ে আছেন। 

অনলাইন প্রোফাইল

ফ্রিল্যান্স ডেভেলপারদের অন্যতম পছন্দের মার্কেটপ্লেস ফাইভার, আপওয়ার্ক, পিপলপারআওয়ার। এছাড়া লিংকডইনেও কন্ট্রাকচুয়াল ওয়েব ডেভেলপমেন্টের বিশাল মার্কেট রয়েছে। কাজ পাওয়ার জন্য মার্কেটপ্লেসের সুযোগ-সুবিধা, কমিশন, ডিমান্ড ইত্যাদি যাচাই বাছাই করে পছন্দের প্ল্যাটফর্মে প্রোফাইল তৈরি করুন। এবার প্রয়োজনীয় তথ্য, প্রফেশনাল পোর্টফলিও, রেজুমি (Resume) ইত্যাদি যোগ করে প্রোফাইল কমপ্লিট করার পালা। যেহেতু মার্কেটপ্লেসে ক্লায়েন্ট প্রথমেই আপনার প্রোফাইল দেখে আপনার সম্পর্কে ধারণা নিবে তাই প্রোফাইল যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করতে হবে। 

পার্সোনাল ব্র্যান্ড তৈরি করা

ওয়েব ডেভেলপমেন্ট আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার চয়েস হলেও ইস্যুও কম নয়। বিশেষ করে নতুন ফ্রিল্যান্স ডেভেলপারদের শুরুতে কঠিন স্ট্রাগলের মুখোমুখি হতে হয়। এই চ্যালেঞ্জ উতরানোর বেস্ট উপায় পার্সোনাল ব্র্যান্ড তৈরি করা। এর জন্য;

#পোর্টফলিও

#নিজের ব্লগ খুলে লেখালেখি

#অন্যান্য প্রফেশনাল, ইনফ্লুয়েন্সার সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি করা

#বিভিন্ন প্রফেশনাল মিটআপ, ইভেন্ট ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা।

#ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকা

প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট- কমিউনিকেশন

ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভাল করতে হলে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে ভাল হতে হবে। এর জন্য নিয়মিত ফাইন্যান্স, টু ডু লিস্ট ক্লায়েন্ট প্রজেক্ট, প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ইত্যাদি ট্র্যাক করা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কাজের চাপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকে। আবার কাজের রুটিনেও ঝামেলা ছাড়াই পরিবর্তন করা যায়। প্রফেশনাল গ্রোথ এটা আপনাকে সাহায্য করবে।