মোহাম্মদ আসিফ, যার পড়াশুনা জীবন শুরু হয়েছিলো মার্কেটিং সাব্জেক্টে । আর এখন কাজ করছেন ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে। যিনি দেশ বিদেশে বিভিন্ন ক্লায়েন্ট এবং এজেন্সি কে সার্ভিস প্রদান করে থাকেন। যার জীবনে লক্ষ্য টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে আরো দক্ষ জনশক্তি তৈরী করা এবং বাংলাদেশ কে আরো শক্তিশালী অবস্থানে তুলে ধরা।

আপনি কিভাবে শুরু করেছিলেন এবং কেন?

আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিলাম ২০১২ সালে। আমার একজন সহকর্মীর সাথে। অডেস্ক ডট কমে এসইও (লিঙ্ক বিল্ডিং) কাজের মাধ্যমে। এর আগে থেকেই ফ্রিল্যান্সিং এর ব্যপারে অনেক বার জেনেছি ফেসবুকের কিছু কমিউনিটি গ্রুপে।  কখনও পত্রিকা পড়ে, কখনও ব্লগে আর্টিকেল পড়ে।

আপনি আসলে কি করেন? 

বর্তমানে আমি ডিজিটাল মার্কেটিং সার্ভিসের সাথে জড়িত। দেশের ও দেশের বাইরের বেশ কিছু কোম্পানি এবং এজেন্সিকে সার্ভিস দিচ্ছি। সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন, সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং, ফেসবুক অ্যাডস, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড, ইউটিউব ভিডিও মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্রাটেজি ডেভেলপমেন্ট এবং কন্সাল্টেন্সি নিয়ে এই সেক্টরে কাজ করছি গত কয়েক বছর ধরে।

ফ্রিল্যান্সিং কেন? 

ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিলাম মূলত সেসময় আমার চাকুরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য। প্রথম দিকে মনে হতো, এতো কম কাজ করে সপ্তাহে এই পরিমাণ টাকা আয় তো বিশাল ব্যপার। সেই সাথে আছে কাজ করার ফ্লেজিবিলিটি। রাত জেগে কাজ করলেও অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদা সেক্টরে কাজ করছি সেটা ভেবে একটা আলাদা মজা পেতাম। 

তবে ধীরে ধীরে এটা আমার খুব ভালো লাগার কাজে পরিণত হয়। স্কিল ডেভেলপ করে ভালো একটা ক্যারিয়ারের সুযোগ দেখতে পাওয়ায় এই সেক্টরেই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জড়িয়ে নেই। 

আপনার পথচলা কতটা কঠিন ছিল?

শুরুটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ প্রথমদিকে কোথাও গিয়ে কাজ শিখি নাই, ইন্টারনেটে বিভিন্ন ব্লগ ঘেটে ঘেটে নিজেই কিছু কাজের আইডিয়া নেই এবং মার্কেটপ্লেসে বিড করি। ইংরেজি কমিউনিকেশনে কিছুটা কনফিডেন্ট থাকায় কাজ পেতে সুবিধা হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে ফেসবুকে বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপ আমাকে প্রচণ্ড হেল্প করেছিল। সেখান থেকে নেটওয়ার্কিং হয়েছে কয়েকজন বেশ ভালো মানুষের, যারা রেগুলার ভালো ভালো পরামর্শ দিতেন। বিভিন্ন সময়ে ক্লায়েন্টদের কাজ থেকেও সরাসরি কাজ করার গাইডলাইন পেয়েছি। যেটা আসলে আমার পথচলাকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ্‌।

এমন কেউ কি ছিলেন যিনি আপনার জন্য অনুপ্রেরণা ছিলেন?

একজন নয়, অনেকেই ছিলেন এবং আছেন। যাদেরকে বিভিন্ন ব্লগ এবং ফোরামে দেখতাম তাদের কাজের অভিজ্ঞতার ব্যপারে রেগুলার লিখতেন। বাংলাদেশি অনলাইন প্রফেশনালস বিভিন্ন গ্রুপেও অনেককে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তবে একেবারে স্পষ্ট করে বললে একজনকে আমি সবসময়ই আলাদাভাবে শ্রদ্ধা করি তিনি হলে মাসুম রানা ভাই। প্রফেশনাল অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং শিখেছি রিফাত ভাই এর কাছ থেকে। আমার ক্যারিয়ারে অনেকের সরাসরি অবদান আছে যেমন আমার বন্ধু মুজাহিদ, শুভ্র, রাসেল, বেলাল সহ অনেকেই। কিছু কাছের বড়ভাই আছেন যাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত হচ্ছি যেমন নাহিদ ভাই, শরিফ ভাই, নাসিরউদ্দিন শামীম ভাই, তাহের সুমন ভাই, ড্রয়েটল্যাবের শাহাদাত ভাই, রায়হান ভাই প্রমুখ।

Asif

আপনি কোন মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন?

আমি মূলত এখন আপওয়ার্কে কাজ করি, তবে খুব বেশি প্রজেক্ট নয়। আমার নিজের অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং এর সাইট আছে। সেখানে কাজ করছি, সাথে ক্লায়েন্ট সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। আমার niravasif.com ব্লগের মাধ্যমেও আমার ক্লায়েন্টের কিছু লিড পাই আমি।

 

ফ্রিল্যান্সিং এ কোন বিষয়টি আপনাকে আকর্ষিত করেছিল?

কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের প্রতি খুব নেশা ছিল আগে থেকেই। বুঝে বা না বুঝেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। যখন দেখলাম এই দিকে কাজ করে টাকা আয় করা যায়, তখন নেশাই পেশা হয়ে দাঁড়ালো।

একজন ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো কি কি? 

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মাইন্ডসেট ধরে রাখা। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ফুল্টাইম কাজ করতে গেলে মাঝেমধ্যে অনেক ঝামেলা হয়। যেমন, হুট করে কাজ পাওয়া কমে যাওয়া, রেটিং কমে যাওয়া, কাজের রেট পরিবর্তন আবার একাউন্ট সাস্পেন্ড হবার মত ঝুকিও থাকে। তাই খুব দৃঢ় মাইন্ডসেট নিয়েই নিজের স্কিল প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে যাওয়া খুব টাফ। সেই সাথে ক্লায়েন্ট কমিউনিকেশনে এক্সপার্ট হওয়ার মত সফট স্কিল এবং ভালো  ডিভাইস এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা এসবও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে একজন ফুল টাইম ফ্রিল্যান্সারের জন্য।

ফ্রিল্যান্সারদের পারিশ্রমিক নির্ধারণে আপনি কোন উপদেশ দিতে চান?

মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে গেলে ক্লায়েন্টের কোম্পানির সাইজ, আগের ফিডব্যাক, জব রেটিং, এবং আপনার কাজের মার্কেট ডিম্যান্ড এসব দেখে চার্জ করা উচিৎ। নতুন ক্ষেত্রে হয়তো প্রথম দিকে পোর্টফলিও বাড়াতে প্রাইসের ক্ষেত্রে কিছুটা কম্প্রোমাইজ করা যেতে পারে, তবে সেটাও একটা ষ্ট্যাণ্ডার্ড প্যাকেজের চেয়ে খুব কম হওয়া যাবেনা। ন্যাগোশিয়েশন স্কিল এখানে একটা ফ্যাক্টর হতে পারে।

আপনি যখন বিড করতে যাবেন তখন আপনার নিজের টাইম ভ্যালু অফ মানি ক্যালকুলেট করে নিবেন। একটা প্রোজেক্টে কাজ করতে আপনার কত ঘন্টা ডেডিকেটেড কাজ করতে হবে। সেটার জন্য আপনি আনুমানিক কত চার্জ করতে চান। আপনার মত অন্য ফ্রিল্যান্সাররা কত প্রাইসে বিড করে করেছে এটাও খেয়াল রাখা জরুরী, তাতে প্রোজেক্ট পাওয়া সহজ হয়।

বাংলাদেশে বসবাস করা অবস্থায় আপনি আপনার আমেরিকান ক্লায়েন্টসগুলোর সাথে টাইমজোনের পার্থক্য টা কিভাবে ম্যানেজ করেন ?

বিশেষ ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট মিটিং গুলার জন্য রাতের দিকে সময় রাখতে হয়। এছাড়া জরুরি ইমেইল গুলোর ক্ষেত্রে রাতে সেগুলার রিপ্লাই দিয়ে দেই। প্রোপার ক্লায়েন্ট কমিউনিকেশনের জন্য আগে তাকে আমার লোকাল টাইম জোনের ব্যপারে বলে দেই। 

আমি সবসময় চেষ্টা করি, ক্লায়েন্টের এন্ড থেকে তাকে কমিউনিকেশনের পুরো সুবিধা দিতে। কারণ একটা প্রোজেক্টে কাজ করার চেয়ে তার সাথে লং টার্ম রিলেশনশিপ বিল্ড করা বেশি জরুরী। তাই প্রথম দিকে আমার একটু কষ্ট হলেও তার সময় মত আপনি তাকে সময় দেই। পরবর্তীতে ভালো সম্পর্ক তৈরি হলে মিটিং টাইম, ডেডলাইন, প্রোজেক্ট সাবমিশন এসবে খুব একটা ঝামেলা হয়না।

আপনি অনেক সময় ধরে কাজ করছেন। এমন কোন ৩টি বিষয়কে আপনি প্রাধান্য দিবেন যা ক্লায়েন্টকে হ্যাপি রাখে?

১. কখনই ফেইক প্রমীজ না করা। যতটুকু সময় বা বাজেট ফিক্সড হয়েছে তার মধ্যে কি পরিমাণ ইনপুট দিতে পারবেন সেটাই ক্লায়েন্টকে জানান। কখনো হিরো সাজতে গিতে ওভার প্রমিজ করবেন না, কারণ তাতে ক্লায়েন্ট আপনার থেকে একটা এক্সপেক্ট করবে বেশি। যখন তা ফুলফিল করতে পারবেন তখন বিশ্রী একটা সিচুয়েশন দাঁড়াবে।

বরং যা প্রমিজ করেছেন তার চেয়ে ১০%-১৫% ওভার ডেলিভারি দিলে ক্লায়েন্টের সুনজরে পড়বেন সহজেই। তাই এই ব্যপারে সতর্ক থাকুন।

২. ক্লায়েন্টকে শুধু শুধু খরচ না করানো। অনেকেই আছে ক্লায়েন্টকে এটা সেটা বুঝিয়ে অনেক বাড়তি খরচ করায়। এটা আসলে কোনো প্রফেশনালের ইথিক্স হতে পারে না। অনেক ক্লায়েন্টই ট্যাকনিক্যাল এরিয়াতে বেশি এক্সপার্ট না হওয়ায় কিছু ফ্রিল্যান্সার এই সুবিধা নেয়। এটা না করে বরং ক্লায়েন্টকে আপনি প্রায়োরিটির অংশ গুলা বুঝান, কোথায় কিভাবে খরচ করলে ভালো রিটার্ন আসতে পারে এগুলা নিয়ে আলোচনা করুন। ক্লায়েন্টের বিজনেস বাড়লে, আপনার কাজ বাড়বে – এটা মাথায় রাখুন। 

ক্লায়েন্টের কাছ থেকে রিপিট অর্ডার পাওয়ার জন্য এই পেশাদারিত্ব জরুরী।

৩. ডেডলাইনের ব্যপারে খুব সচেতন থাকা, কাজ যদি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে ক্লায়েন্টকে ক্লিয়ার করে জানিয়ে দেয়া যে কাজের মানের দিকে খেয়াল রেখে কমপ্লিট করাতে সময় একটু বেশি লাগতে পারে।

এই ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন যারা তাদের জন্য আপনার কোন পরামর্শ

ফোকাস থাকা, স্কিল ডেভেলপ করা এবং কুইক একশনে নেমে পড়া। এই ২০২১ সালে এসে কাজ না শিখে মার্কেটপ্লেসে দৌড়ানো সম্ভব নয়। তাই আগে এমন কাজ শিখুন যেটার ডিম্যান্ড এখন আছে এবং আগামি কয়েক বছরে সেটার সুযোগ আরো বাড়বে। যেই কাজে অলরেডী প্রচুর ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন সেখানে নিউ কামার হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করতে হলে আপনাকে অনেক এক্সপার্ট লেভেলে পৌছাতে হবে। কারণ মার্কেটে অলরেডি প্রচুর এক্সপার্ট কাজ করছেন, তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করেই আপনাকে কাজ বাগিয়ে নিতে হবে।

নিজের ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি দিয়ে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিকে সেবা প্রদান করা। বাংলাদেশ থেকে অলরেডি আমাদের টিম বাইরের বেশ কিছু এজেন্সিকে সার্ভিস দিচ্ছে। সাথে বাংলাদেশের কিছু কোম্পানির সাথেও আমরা কাজ করছি। নিকট ভবিষ্যৎ এ এটাকে আরো অনেক বড় আকারে নিতে চাই। প্রচুর মানুষের রিজিকের উছিলা হতে চাই যদি আল্লাহ্‌ পাক চান।

কাজ করার পাশাপাশি আমি ডিজিটাল মার্কেটিং মেন্টর হিসেবে কাজ করছি ৩ বছর ধরে। আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমার অনেক শিক্ষার্থী অনেক ভালো ভালো জায়গায় নিজের স্কিল এর মাধ্যমে সুনামের সাথে কাজ করছেন। আমার নিয়ৎ আছে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ দক্ষ ডিজিটাল মার্কেটার তৈরি করা যেন তারা দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম বাড়াতে পারে।