মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় এই কথাটির একটি বাস্তব উদাহরণ সুশান্ত কুমার চৌধুরী। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ছাত্র থেকে তিনি আজ হয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্তর্জাতিক এজেন্সির প্রধান নিবার্হী। নিজের কাজে লেগে থাকার ধৈর্য, আগ্রহ, দক্ষতা এবং নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অসাধারণ ক্ষমতা তাকে আজ এই স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।

সুশান্ত কুমারের পথচলা

২০১৫ সালে কলেজের প্রোগ্রামগুলোতে সুশান্ত কুমার প্রথমবার ফ্রিল্যান্সিং এর কথা শোনেন। ২০১৬ সালে তিনি গ্রাজুয়েশনের জন্য খুলনা আসেন। তখন তিনি তার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ফ্রিল্যান্সার হবার সিদ্ধান্ত নেন। বিকল্প হিসাবে তিনি তখন টিউশনি বা অন্য কোন আয়ের পথ ও খুঁজেছিলেন। কিন্তু প্রায় কিছুই খুঁজে পাননি। ২০১৬ সালের শেষদিকে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং সেখানকার পড়ালেখার খরচ তার পক্ষে চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তখন থেকে তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা ভাবতে শুরু করেন কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে ফেসবুক থেকে সুশান্ত কুমার একটি গবেষণার প্রজেক্ট পান এবং তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর সেখানে তার কাজ শেষ হয় এবং তখন থেকে তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়ার কাজ শুরু করেন। তিনি গুগলে আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, পিপিসি এবং আরো কিছু মার্কেটপ্লেস এর সন্ধান পান। সে বছর মার্চ মাসের ১৫ তারিখে তিনি আপওয়ার্কে তার প্রথম ফ্রিল্যান্সিং কাজ পান।

সুশান্ত কুমার এর কাজ

সুশান্ত কুমার এর কাজ অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারের চাইতে খানিকটা আলাদা। ফ্রিল্যান্সিং এর প্রায় সবগুলি ক্ষেত্র নিয়েই তিনি ও তার টিম কাজ করেন। তার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল একজন ইন্টারনেট রিসার্চ এবং লিড জেনারেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে। এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ‘ভেশন ভেঞ্চার’ নামক একটি আমেরিকান কোম্পানিতে ফুলটাইম কাজ শুরু করেন। সে বছরের শেষদিকে তিনি তার বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পদোন্নতি অর্জন করেন। অন্যদিকে আপওয়ার্কে তিনি ফ্রিল্যান্সার্স ডেস্ক নামে একটি এজেন্সি চালু করেন। ফ্রিল্যান্সার্স ডেস্ক বর্তমানে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভলপমেন্ট, ইউ.আি ও ইউ.এক্স ডিজাইন, ইন্টারনেট রিসার্চ, লিড জেনারেশন, ডাটা এন্ট্রি সার্ভিস নিয়ে কাজ করে। ২০১৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উয়েমিং এ তার কোম্পানি ‘ব্যাকস্পেস গ্লোবাল এলএলসি’ এর রেজিস্ট্রেশন করেন। এই কোম্পানির মাধ্যমে তিনি তার সকল ক্লায়েন্টকে সরাসরি সেবা দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমি আর সরাসরি কাজ করিনা। আমার টিম সব ধরনের কাজ সামলায়। মূলত আমার ব্যবসাকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়েই ব্যস্ত থাকি’।

ফ্রিল্যান্সিং করার যোগ্যতা ও দক্ষতা

সুশান্ত কুমার বলেন, ‘ইন্টারনেট রিসার্চ ও লিড জেনারেশন এর ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের বিষয়গুলোতে পারদর্শী হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী ইন্টারনেট থেকে সঠিক তথ্য এবং বিস্তারিত উপাত্ত ও গবেষণা খুঁজে বের করতে হবে। আইটি খাত নিয়ে আপনার যদি যথেষ্ট জ্ঞান থাকে তাহলে এটি আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী চাকরিগুলো পেতে সাহায্য করবে। কম্পিউটার সায়েন্সের একজন ছাত্র হিসেবে আমি প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল এপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, ইউ.আই এবং ইউ.এক্স. ডিজাইন বিষয়গুলো ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী বুঝতে পারি এবং এর মাধ্যমে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। তাই ব্যবসার লক্ষ্য অর্জন করতে নিজের কর্মক্ষেত্র ও কাজ নিয়ে যত গভীরভাবে জানা যায় ততই উন্নতি করা সম্ভব।’

কেন ফ্রিল্যান্সিং

Susanto Kumar Chowdhuryসুশান্ত কুমার চৌধুরী ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে সবচাইতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ের অন্য যে কোন সুবিধার চাইতে আমি স্বাধীনতার কথাটাই আগে বলবো। ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমি নিজের সময় এবং পেশাকে নিজের ইচ্ছে মত গুছাতে পারি। তাছাড়া এর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করার সুযোগ পাই। ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে আমি আমার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পেরেছি যেখানে আমি আরো বিশ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি।

প্রতিকূল পথ কিন্তু ধৈর্যই শক্তি

প্রতিকূল পরিবেশে সুশান্ত কুমার চৌধুরীর ক্যারিয়ার শুরু হয়। পড়াশোনার খরচ চালানো তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনি কোন ফ্রিল্যান্সার কে চিনতেন না যে তাকে এই বাজারে পথ দেখাবেন। আর ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্যারিয়ার শুরুর সময়ে বাজারে ক্লায়েন্ট এর চেয়ে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছিল বেশি। প্রথমদিকের প্রজেক্ট গুলোতে দৈনিক ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করার পরেও খুবই অল্প উপার্জন করা সম্ভব হতো। কিন্তু সুশান্ত কুমার সবসময়ই নিজের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন এবং আজকের এই স্থানে পৌঁছেছেন।

সুশান্ত কুমার এর অনুপ্রেরণা

সুশান্ত কুমার বলেন সত্যি বলতে আমি কোন ফ্রিল্যান্সার চিনতাম না যার কারণে কোন ফ্রিল্যান্সার দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হই নি। সে সময়ে গুগল এবং ইউটিউবই আমাকে বরং জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দেয়। প্রতিদিনই আমি আর্টিকেল পড়তাম আর ভিডিও দেখতাম। এর মাধ্যমে আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুবিধা গুলো জানতে পারি এবং এগুলোই আমাকে পরবর্তীতে উৎসাহিত করেছে ।

সুশান্ত কুমার এর কাজ ও কর্মক্ষেত্র

সুশান্ত কুমার আপওয়ার্কে তার কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে ক্লায়েন্টদের মধ্যে তার পরিচিতি বেড়ে গেলে তিনি লিংকড ইন এবং তার গন্ডির ক্লায়েন্টদের রেফারেন্সের মাধ্যমে কাজ পেতে শুরু করেন। তার দীর্ঘমেয়াদী ক্লায়েন্টরা বেশিরভাগই গতানুগতিক ফ্রিল্যান্সিং বাজারের বাইরে গিয়ে তাকে কাজ দেন। নিজের কাজের পরিধি বাড়ানো এবং ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে তিনি গতানুগতিক ফ্রিল্যান্সারদের চাইতেও বেশি উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন।

ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্ট করতে সুশান্ত কুমারের পরামর্শ

সুশান্ত কুমার ক্লায়েন্টদের খুশি রাখার বিষয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘কাজ করার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব সবচাইতে জরুরী। আপনাকে পেশাদারিত্ব, সততা এবং কমিউনিকেশন স্কিল এর মাধ্যমে ক্লায়েন্টের সাথে সম্পর্ক করতে হবে।
কমিউনিকেশন স্কিল ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রজেক্ট এর বাজেট যদি কমও হয় তবুও আপনাকে সময়ের মধ্যে ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। যোগাযোগ এবং সময়ানুবর্তিতা নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। প্রজেক্ট শেষ হবার পরেও ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। একবার এক ক্লায়েন্টের কাছে মাত্র পাঁচ ডলারের একটি কাজ করার পরে তার সাথে যোগাযোগ রাখার পরে আমি বিশ হাজার ডলারের কাজ পাই।

তৃতীয়ত, আপনাকে ডেডলাইনকে সম্মান করতে হবে এবং ক্লায়েন্টকে নিয়মিতভাবে আপডেট জানাতে হবে যাতে সে আপনাকে ফিডব্যাক দিতে পারে।

নতুনদের জন্য সুশান্ত কুমার এর পরামর্শ

ফ্রিল্যান্সিং খাতে নতুন আসা তরুণদের বিষয়ে সুশান্ত দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, ‘মার্কেটপ্লেসে আসার আগে আপনাকে যথেষ্ট দক্ষ এবং আগ্রহী হতে হবে। আপনার যদি যথেষ্ট আগ্রহ না থাকে তাহলে আপনি যত টাকাই পান আপনি এই কাজ করে সুখী হতে পারবেন না। শেখার কোন শেষ নেই এবং এই প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের দক্ষতা নিয়মিতভাবে শান দিতে হবে। সবসময় নতুন নতুন জিনিস শিখতে হবে। আর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে মোটামুটি উন্নতি করতে পারলে আপনাকে মার্কেটপ্লেসের বাইরে গিয়ে নিজের এবং নিজের প্রতিষ্ঠান এর ব্র্যান্ডিং করতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস নতুনদের জন্য ভালো হলেও এখানে সুযোগ সীমিত। তাই মার্কেটপ্লেসের বাইরে সব সময় বড় স্বপ্ন দেখা উচিৎ।


ফ্রিল্যান্সিং করে কেবল টাকা অর্জন করা সম্ভব কিন্তু বড় কিছু হওয়া সম্ভব না – এমন ধারণাকে পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করেছেন সুশান্ত কুমার চৌধুরী। সাফল্য ও উন্নতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। তিনি শুধু নিজের ক্যারিয়ারই উন্নতি করেন নি বরং বিশ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক বাজারে সুনামের সঙ্গে কাজ করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।