সঠিক পরিকল্পনায়ই যেকোনো কাজের অর্ধেকটা সম্পন্ন করে দেয়। আর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিং জগতে একজন সফল ব্যক্তিত্ব সাইফুল ইসলাম সোহেল। এক দশক ধরে ফ্রিলান্সিং পেশায় নিয়োজিত সাইফুল ইসলাম তার দক্ষতা যোগ্যতা ও পরিকল্পনার সূত্র ধরে আজ সফলতার সঙ্গে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে এবং সরাসরি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।

সাইফুল ইসলাম সোহেলের পথচলা

২০১১ সালে সাইফুল ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে জানতে পারেন এবং ওডেস্কে নিজের একটি প্রোফাইল তৈরি করেন। সেখানে তিনি ক্লায়েন্টদের চাকরির পোস্টগুলি দেখতেন এবং কয়েকদিন দেখার পর তিনি বুঝতে পারেন যে, এই কাজগুলি করার মত কোন দক্ষতাই তার নেই। সেসময় তিনি ব্লগ এবং ইউটিউব থেকে কাজের দক্ষতা অর্জন করা শুরু করেন। শুরু থেকেই সাইফুল ফ্রিল্যান্সিং সংশ্লিষ্ট খবরাখবর গুগল এর মাধ্যমে খুঁজতে পছন্দ করতেন। তারপর ২০১৩ সালের শুরুতে তিনি ওডেস্কে আবার ফিরে আসেন এবং সাত দিনের মাথায় তিনি তার প্রথম কাজ পান। এটা ছিল মাত্র পাঁচ ডলারের একটি কাজ কিন্তু এটি শেষ করার পর থেকে তিনি নিয়মিত কাজ পেতে থাকেন। তারপর কখনোই তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সাইফুল ইসলাম সোহেল এর কাজ

সাইফুল আপওয়ার্কে একজন ফ্রিল্যান্সিং ইন্টারনেট রিসার্চার এবং লিড জেনারেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। মূলত তিনি সেলস এবং মার্কেটিং এর জন্য বাজার খুঁজে পেতে সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করেন। এই তালিকা অনুসারে কোম্পানিগুলো তাদের সম্ভাব্য কাস্টমার এর কাছে তাদের পণ্য ও সেবাগুলো পৌছে দেয়।

কেন ফ্রিল্যান্সিং

ফ্রিল্যান্সিংকে কেন পেশা হিসেবে বেছে নিলেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার যে দক্ষতা ও জ্ঞান আছে আমি সেগুলো দেশীয় বাজারে বা চাকরিতে কোন কাজে লাগাতে পারি না। ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে আমার দক্ষতার মূল্য আছে এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আমি ফ্রিল্যান্সিং ভালোবাসি। এখানে আমি যে পরিমাণে অর্থ উপার্জন করি তা আমাদের দেশীয় চাকরির বাজারে পাওয়া বিরল।’

সাইফুল ইসলামের চলার পথে চ্যালেঞ্জ

সাইফুল ইসলাম এর যাত্রার শুরুর দিকে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সেই সময়ে ইন্টারনেটের ধীরগতি ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাইফুল ইসলাম তখন সিটিসেলের জুম আল্ট্রা ব্যবহার করতেন এবং তাতে ৫০০ কেপিবিএস বা সর্বোচ্চ ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ পাওয়া যেতো। এর জন্য মাসিক ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে তাকে প্রচুর টাকা খরচ করতে হতো। যেহেতু সে সময় তাকে তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ খুঁজে পেতে হাজার হাজার পাতা ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে হতো, সেহেতু এই ধীরগতির ইন্টারনেট স্পিড তাকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিতো। তবে সাইফুলের যাত্রার শুরু থেকেই তার পরিবার তার পাশে ছিল এবং পরিবারের এই সাহচার্য তার পরিশ্রম এবং কষ্টগুলোকে সহজ করে দিতো।

সাইফুল ইসলামের অনুপ্রেরণা

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সত্যি বলতে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সে সময় আমার কাছে অনুপ্রেরণার উৎস বলে কেউ ছিলেন না। আমি কোন ফ্রিল্যান্সারকে চিনতাম না। আমাকে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেউ থাকলে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ হতাম।’

সাইফুল ইসলাম সোহেলের মার্কেটপ্লেস

অন্যান্য ফ্রিল্যান্সাররা নানান রকম মার্কেটপ্লেসে কাজ করলেও সাইফুল ইসলাম শুধু আপওয়ার্ক ডট কমে কাজ করেন। এর বাইরে তিনি তার এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি ক্লায়েন্টদের সেবা দিয়ে থাকেন। সাইফুল বলেন, ‘কেবল আপওয়ার্ক নিয়ে কাজ করলে আমার হয়তো অন্যান্য মার্কেটপ্লেসে কাজ খোঁজার প্রয়োজন পড়তো কিন্তু ক্লায়েন্টদের সাথে সরাসরি কাজ করার ফলে আমার কাজের ব্যস্ততা কখনো কমে না। তাই অন্য মার্কেটপ্লেসে আমার কাজ খুঁজতে হয় না।’

যে কারণে আজ সাইফুল একজন ফ্রিল্যান্সার

Saiful Islam Sohelসাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং আমার জন্য একটা ধোঁয়াশা ছিল। আমি ভাবতাম ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে আসলেই অনলাইন থেকে টাকা উপার্জন সম্ভব কিনা। টাকা উপার্জন এবং এই মার্কেটপ্লেসের বিষয়ে কৌতুহল এর ফলে আমি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। মূলত কৌতুহলই আমাকে একজন ফ্রিল্যান্সার বানিয়েছে।’

যেভাবে সাইফুল তার দক্ষতা বাড়িয়েছেন

প্রতিটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য নিয়মিতভাবে নিজের দক্ষতা বাড়ানো এবং বাজার সাথে খাপ খাওয়ানো প্রয়োজন রয়েছে। একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সাইফুল নিয়মিতভাবেই তার দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তিনি নিয়মিত ভাবে বাজার বিষয়ক ব্লগ, ফ্রিল্যান্সিং ব্লগ পড়েন। এছাড়া এই খাতের প্রভাবশালী ফ্রিল্যান্সার এবং অন্যদের তিনি অনুসরণ করেন।

ফ্রিল্যান্সার হবার বিপত্তি

ফ্রিল্যান্সিং সবসময়ই প্রথাগত চাকরি বা ব্যবসা চাইতে আলাদা। সাইফুল ইসলাম মনে করেন প্রথাগত চাকরির মত ফ্রিল্যান্সিংয়ের কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আছে। তিনি বলেন, ‘শুরুতে কর্মঘন্টার ভারসাম্য তৈরি করতে আমি হিমশিম খেতাম। এবং ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আমাকে সবসময়ই চাকরির চাইতে বেশি সময় ধরে পরিশ্রম করতে হয়। তাই সময় এবং বিশ্রাম এর সমন্বয় করা আমার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়া নতুন কাজ পেতে এবং ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে আমাকে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমার স্বাস্থ্যে এর খারাপ প্রভাব পড়ে। তাই আমি মনে করি নতুন ফ্রিল্যান্সারদের অবশ্যই একটি সুন্দর রুটিন বানিয়ে সেটা মেনে চলা উচিত।’

ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুবিধা

ফ্রিল্যান্সিং পেশাগত স্বাধীনতার একটি বৃহত্তর ক্ষেত্র। সাইফুল মনে করেন ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে নিজের ওপর নির্ভরশীল থাকা যায় এবং যে বিষয়ে আগ্রহ সে বিষয় নিয়েই নির্দিষ্ট ভাবে কাজ করা যায়। তিনি বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সার হবার ফলে আমি আমার কাজগুলো যখন ইচ্ছা তখন করতে পারি। আমি কোন কাজ করবো আর কোন কাজ করবো না; সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার নিজের।’

ক্লায়েন্টকে খুশি রাখতে সাইফুল ইসলামের পরামর্শ

ক্লায়েন্টকে খুশি রাখা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফল হবার মূলমন্ত্র। এ বিষয়ে সাইফুল ইসলাম নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, ‘সাধারণত নতুন ফ্রিল্যান্সাররা ক্লায়েন্টদের যথেষ্ট পরিমান প্রশ্ন করতে ইতস্ত বোধ করেন। কিন্তু প্রজেক্ট বিষয় স্পষ্ট ধারণা পেতে ক্লায়েন্টকে প্রশ্ন করতে হবে। অনুমানের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সম্পূর্ণ ধারণা নিয়ে কাজে হাত দেওয়া উচিত।

কাজ শুরু করার পর ক্লায়েন্টের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা উচিত। কাজের অগ্রগতি অথবা কোন সমস্যায় পড়লে ক্লায়েন্টকে স্পষ্টভাবে তা জানানো উচিত। এতে ক্লায়েন্টও খুশি হন।
ক্লায়েন্টরা ভালো মানের কাজ পেতেই ফ্রিল্যান্সারদের খোঁজেন। তাই কাজের গুণগত মানের সাথে কোন আপোষ নয়। অবশ্যই আপনার সর্বোচ্চ টা দিয়ে ক্লায়েন্টকে খুশি করতে হবে এবং কাজের মান রক্ষা করতে পারলেই আপনি সামনেও ভালো কাজ পাবেন।’

নতুনদের জন্য সাইফুলের পরামর্শ

নতুনদের জন্য সাইফুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘নিজের কাজের দক্ষতা অর্জন করার সময় এমন ধরনের কাজ বেছে নেওয়া উচিত যাতে মার্কেটপ্লেসে সেই কাজের চাহিদা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। নিজের দক্ষতা অর্জন করার সময় তাড়াহুড়ো করা আত্মঘাতী। দক্ষতা অর্জনের জন্য কিছুটা বেশি সময় লাগলেও কাজটা শতভাগ শিখে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ এই শিক্ষার উপরই আপনার পুরো ভবিষ্যৎ দাঁড়াবে। ফ্রিল্যান্সাররা সাধারণত টাকা উপার্জনের পরপরই তা খরচ করে ফেলেন। কিন্তু টাকা সঞ্চয় করা খুবই জরুরী না হলে এটি ভবিষ্যতকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। মনে রাখতে হবে ফ্রিল্যান্সিং এ পেনশনের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই টাকা সঞ্চয় মাধ্যমে নিজেই নিজের পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে।’

সাইফুল ইসলামের স্বপ্ন

সাইফুল ইসলাম তার কাজে প্রতিনিয়তই এগিয়ে চলেছেন। তার এই অগ্রযাত্রায় তিনি নিজেকে আরও বিকশিত করে বড় হবার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনলাইনে কাজ করে যেতে চাই এবং টাকা সঞ্চয় এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই কাজের পাশাপাশি বাজার চাহিদা অনুযায়ী একজন বিনিয়োগকারী হতে চাই। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আর্থিক সুরক্ষা খুব জরুরী। আর্থিক সুরক্ষা ছাড়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব না।’

একজন আদর্শ ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে যে কয়টি গুণ থাকা প্রয়োজন তার সব কয়টি পরিপূর্ণভাবে সাইফুল ইসলাম সোহেলের ব্যক্তিত্বের মধ্যে মিশে আছে। কাজ, দক্ষতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং ভারসাম্য – এইসব কয়টি ক্ষেত্রে সাইফুল ইসলাম, নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একজন অনন্য দৃষ্টান্ত।