মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, একথাটি আমরা অনেক বার শুনেছি, শুনার পর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস কাজ করে। কিন্তু তারপরে ও সবার শুরু করা হয়ে উঠে না। অথচ আমাদের আশেপাশেই এমন প্রচুর উদাহরণ আছে, যেখানে ছোট একটি শুরু এক সময় অনেক বড় কিছু হয়ে যায়। 

আজকে আপনাদের সাথে এরকম একজনের গল্প শেয়ার করবো যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং ফিল্ডে তার ঘটনাচক্রে আসা। এটি তার প্রথম দিকের প্রায়োরিটি ছিল না। এখন সেই ফিল্ডেই দারুন কাজ করে অনেক মহিলা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য তিনি নিজেকে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বলছি নাজমুন নাহার এর কথা যিনি ২০১৫ সালে এসইও (SEO) প্রফেশনাল হিসেবে আপওয়ার্কে কাজ শুরু করেন। চলুন জেনে আসি তার ফ্রিল্যান্সিং জার্নি সম্পর্কেঃ

কখন এবং কিভাবে ফ্রিল্যান্সিং এর শুরু

তিনি ছোট বেলা থেকেই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তাই মাস্টার্স করার সময় থেকেই তার লক্ষ্য ছিল বিসিএস ক্যাডার হবেন। তিনি ২০১৩ তে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর একটি প্রাইভেট কোম্পানি তে জয়েন করেন। 

চাকরি তে জয়েন করে ও তিনি পড়া লেখা চালিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সেটি বেশী দিন কন্টিনিউ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। কারনটি বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে খুবই কমন। মেয়েদের বিয়ের পর ফ্যামিলি এবং চাকরি সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তার ক্ষেত্রে ও ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। তিনি বলেন,” তখন আমার ১.৫ বছর বয়সী মেয়ে ছিল। মেয়েকে আমার মা এবং হাসবেন্ড ছাড়া রেখে আসার সাহস পেতাম না। কিন্তু এভাবে বেশীদিন চলা যায় নি। মেয়ের প্রায়োরিটি ছিল আমার কাছে বেশী যার ফলে তখন আমার কাজে প্রচুর প্রবলেম ফেস করতে হয়েছিল। তাই সে কাজ আমার কিছুদিন পর ছেড়ে দিতে হয়।”

তিনি ছোট বেলা থেকেই খুব উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি তার ক্যারিয়ারে কিছু করতে চেয়েছেন সবসময়। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঐ সময়টুকু তাই তার জন্য কঠিন ছিল। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরের সময়টুকু কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন,”খুব কঠিন এক সময় ছিল আমার জন্য। এভাবে কিছু করবো না, চুপচাপ ঘরে বসে থাকা লাগবে ভেবে শুরুতে খুব ডিপ্রেসড হয়ে পরেছিলাম। আমার স্বামী আমার এরকম অবস্থা দেখে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে বলে। আমাকে এর আগে ও ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে উৎসাহ দিয়েছে। এরপর থেকে ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু। ঐ সময়টাতে আমি মার্কেট প্লেস এবং এসইও নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলাম। তারপর দেখতে দেখতে এখানেই আমার স্যাটেল হয়ে যাওয়া।” 

চাকরি ছাড়ার ঐ বছরই তিনি আপওয়ার্কে একাউন্ট খুললেও সে বছর কাজ করা হয় নি। ২০১৫ তে এসে 

তিনি প্রথম কাজ পেয়েছিলেন এবং তখন থেকেই তিনি ফ্রিল্যান্সিং এ রেগুলার হন। এরপর থেকে তার সাফল্য যাত্রা শুরু হয় এবং তাকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয় নি। 

তিনি যে কাজ করে থাকেন

তিনি বর্তমানে এসইও কন্সালটেন্ট এবং ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। শুরুতে তিনি এসইও প্রফেশনাল হিসেবে আপওয়ার্কে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, “এসইও এর কাজ গুলো মুলত ছোট ছোট অনেক গুলো সেকশনে বিভক্ত।” তাকে তাই আগে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হতে দেখা যায়। লিঙ্ক বিল্ডিং, অন পেইজ এসইও, অফ পেইজ এসইও, কন্টেন্ট অপ্টিমাইজেশন এসব কাজগুলো এসইও কাজের মধ্যে পড়ে। এসইও প্রফেশনাল হিসেবে জয়েন করতে চাইলে আপনার এসকল কাজের ব্যাপারে ধারণা থাকা লাগবে। 

এসইও প্রফেশনাল হিসেবে যেসব স্কিলসেট প্রয়োজন

তার বহুদিনের এক্সপেরিয়েন্স থেকে তিনি নতুন এসইও ফ্রিল্যান্সারদের কিছু আবশ্যিক স্কিলসেট রাখতে বলেছেন। একজন এসইও প্রফেশনাল হিসেবে তার মতে ক্রিয়েটিভ চিন্তা করা এবং টেকনিকাল বিষয় গুলো বুঝা হচ্ছে প্রাইমারি নেসেসিটি। তিনি এইচটিএমএল(HTML) ও সিএসএস(CSS) এর বেসিক জানার প্রতি ও গুরুত্ব দিয়েছেন। আসুন জেনে আসি স্কিলসেট সম্পর্কে বলা তার ইন্টারভিউয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশঃ

এসইও প্রফেশনাল হিসেবে সাকসেসফুল হতে আমার কাছে ডাটা এনালাইসিস স্কিলটি হচ্ছে অতীব জরুরী। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “অরগানিক ট্রাফিক কোথা থেকে আসছে, কোন ডিভাইস ইউজাররা মোস্টলি ব্যবহার করছে, সাইটের কোন পেইজটি ভাল র‍্যাংক করছে এসব এনালাইসিস প্রতিটি ইন্ডিভিজুয়ালের কোন না কোন সময় তার কাজে লাগবে। তাই এক্সসেল (Excel) এ ডাটা প্রসেসিং এর যে টেকনিক গুলো আছে, সেগুলো জানা থাকলে আমি মনে করি এনালাইসিং এর কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। পরবর্তী তে আপনি এই ডাটাগুলো ইজিলি ভিজিউয়ালাইজ (visualize) করে ডিসিশন মেকিং এ যেতে পারবেন।”

“এছাড়া নতুনদের উদ্দেশ্যে বলবো  ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ এর প্রতি যতটা সম্ভব মনোযোগ দেওয়া যায় তত ভাল। এই ফিল্ডে ভাল করতে প্রপার ইংলিশ কমিউনিকেশন স্কিল থাকা চাই। যেহেতু ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেস সব ইন্টারন্যাশনাল ক্লায়েন্ট, তাই ইংরেজী কমিউনিকেশন করতে পারাটা অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন আপনার ক্লায়েন্টকে এপ্রোচ করবেন তখন আপনার সার্ভিস সেল বা আপনার মার্কেটিং প্ল্যান তাকে জানাতে হবে এবং তাতে আপনার ন্যূনতম ইংরেজী স্কিল থাকাই লাগবে। তা না হলে আপনি মার্কেট প্লেসে তেমন সুবিধা করতে পারবেন না। “

ফ্যামিলি এবং ফ্রিল্যান্স লাইফ যেভাবে মেইন্টেইন করেছেন

Nazmun Nahar“ফ্রিল্যান্সিং এর শুরুর যাত্রা ও আমার জন্য সহজ ছিল না। যেহেতু বাসায় বসেই কাজ করতে হচ্ছে এটি সবার জন্য ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। শুরু তে আমি যে কাজ করছি এটা মেইন্টেইন করাটা বাসার সবার জন্য একটু কঠিন হয়ে যেত। বাসায় দেখে অনেকেই ভাবতো আমি ফ্রি আছি। দেখা যেত বাসায় মেহমান সামলানো অথবা কোন দিন বাচ্চার অসুস্থতার কারনে দিনের কাজ ঠিক ভাবে ধরতেই পারি নি। পরে ঐ কাজ গুলো আমাকে রাত ১২ টার পরে ধরতে হয়েছে। এভাবে বেশ কিছুদিন আমাকে রাত জেগে কাজ গুলো কমপ্লিট করতে হয়েছে। আমার ঐ দিন গুলো ২-৪ ঘন্টার ঘুমেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম একটি রুটিন বানানো দরকার যাতে করে সব কিছু অরগানাইজড থাকে। বর্তমানে আমার ফিক্সড রুটিন থাকায় এখন আর আগের সেই স্ট্রাগল করতে হয় না। আমার আপকামিং মহিলা ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি ও সেইম এডভাইস থাকবে। তাদের প্রতিদিনের কাজের ফিক্সড রুটিন বানানো উচিত। এতে করে বেশ কিছু কাজ আগে থেকে প্ল্যান হয়ে গেলে ওরকম স্ট্রেস পোহাতে হয় না। তারপর ও আমি বলবো শুরুর দিকের এই শ্রম সব মেয়েদের উপরেই যাবে। সবাই কে এই সিচুয়েশনের উপর মেন্টালি প্রিপেয়ার হয়েই কাজ করতে হবে। “

ফ্রিল্যান্সিং এ মেয়েদের প্রিপারেশন নিয়ে

 তিনি লক্ষ্য করেছেন, নতুন যারা ফ্রিল্যান্স কাজে জয়েন করছে, তারা অল্পেই অধৈর্য হয়ে পড়ে। তারা বেশী বেশী ডলার কামানো কেই প্রাধান্য দিচ্ছে। যেটি তিনি ভুল কনসেপ্ট বলে মনে করেন। শুরু তে ছোট ছোট কাজ করে শিখে নেওয়া টা তার কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে হোক সেই প্রজেক্টটি খুব লো স্যালারির। 

তার শুরুর ফ্রিল্যান্স লাইফে ও আমরা এই উদাহরণ দেখতে পাই। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ আমি  সবসময় লার্নিং কে গুরুত্ব দিয়েছি। এজন্য আমি আমার ক্যারিয়ারের প্রথম সময়ে আসা ৩ ডলারের একটি টিম প্রজেক্টে যুক্ত হই এবং একইসময়ে আসা ৭ ডলারের একটি ইন্ডিভিজুয়াল কাজ আমি রিজেক্ট করি। ৭ ডলারের ঐ প্রজেক্টটি তখন আমার কাছে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব ছিল। কিন্ত ঐ প্রজেক্টটি আমি রিজেক্ট করেছি কেননা আমার এক্সিসটিং নলেজ দিয়েই কাজ গুলো শেষ করা যেত। কিন্তু ৩ ডলারের ঐ প্রজেক্টটিতে টিমের বাকিরা অনেক এক্সপেরিয়েন্সড এবং নলেজেবল ছিল আমার চেয়ে। শুধুমাত্র কিছু লার্নিং পাবার আশায় আমি ঐ প্রজেক্টটিতে যুক্ত হই।”

তার এই ডিসিশনটি যে ঠিক ছিল পরবর্তী তে আমরা তা দেখতে পাই। রিসেন্টলি তিনি তার এক প্রজেক্টের ক্লায়েন্ট থেকে ঘন্টায় ২০ ডলার করে পেতেন; শুধু মাত্র তার কাজে ইম্প্রেসড হয়ে চার মাসের মাথায় এখন তিনি ঘন্টায় ৩০ ডলার করে পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি ঐ ক্লায়েন্টকে স্যালারি রেট বাড়ানোর জন্য কিছু বলেন নি। তাই যাদের স্কিল থাকবে, তারা এভাবে পুরস্কৃত হতে থাকবে। নতুনদেরকেও এই রুটের যাত্রী হিসেবে তিনি উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। 

এছাড়া সম্ভাবনাময় এরকম মহিলা ফ্রিল্যান্সারদের তিনি ইংরেজী শিখার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, অনেকে ফ্রিল্যান্সার হতে চাইলেও বেসিক কম্পিউটিং স্কিল সম্পর্কে জানে না। যেমনঃ টাইপিং, নেট ব্রাউজিং ইত্যাদি। ফ্রিল্যান্সিং করতে চাইলে এসব বেসিক স্কিল থাকাটা প্রাইমারি নিড। 

মেয়েদের তিনি স্ট্রাগল ফেসটা অভারকাম করার জন্য মেন্টালি প্রিপারেশন রাখতে বলেছেন। তিনি মনে করেন শুরুর ঐ টাইমটুকু ম্যানেজ (manage) করে নিতে পারলে দুই লাইফ সমানভাবে মেইন্টেইন/ব্যালান্স করা সম্ভব। 

নতুনদের জন্য কিছু টিপস

তার লাইফ থেকে যেটি দেখা যায়, তিনি কখনো গিভ আপ করেননি এবং আগ্রহ, ধৈর্য ধরে রেখে তিনি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। তিনি সবসময় নতুন লার্নিং কোথায় পাওয়া যাবে এ ব্যাপারে খোজ করেছেন। তাই নতুনদের কিছু টিপস দিতে বলা হলে তিনি বলেন, “ফ্রিল্যান্সিং ফিল্ডে ধৈর্য ধরে রাখাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুন। সবাইকে শুরুতেই ডলারের পিছনে ছুটতে আমি মানা করবো বরং শুরুতে যত বেশী  কাজের এক্সপেরিয়েন্স এবং লার্নিং পাওয়া যায় তার দিকে চেষ্টা করতে বলবো। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিং হিসেবে যে আপনার ক্যারিয়ার আছে তা বিলিভ করতে পারাটা খুব জরুরী। তাই ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার পূর্বে মেন্টালি সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে রাখবেন।”

এরপর তিনি সবাই কে যে কোন সমস্যায় পড়লে গিভ আপ করতে না করেছেন যেটি আপনার সাকসেস এর পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়ায়। আপনি কোথায় প্রবলেম এ পড়েছেন, এর সলিউশন কি এসব আপনাকে প্রতিনিয়ত খুজার চেষ্টা করে যেতে হবে। তিনি টপ ফ্রিল্যান্সারদের ফলো করতে বলেছেন এবং তাদের কে মেন্টর হিসেবে নিয়ে প্রবলেম গুলোর সলিউশনের পথ দেখে নিতে বলেছেন।

লাস্টলি তিনি মনে করেন, নিজেকে টেকনোলজিকাল ট্রেন্ডের সাথে আপ টু ডেট রাখতে শিখতে হবে। কেননা, টেকফিল্ডে প্রায়ই নতুন নতুন কিছু আপডেট আসে। এসই ও রুলস , এলগোরিদম প্রায়ই চেঞ্জ হচ্ছে, তাই নতুন এসব আপডেট জানা থাকা জরুরী। তা না হলে অন্য অনেকের চাইতে পিছিয়ে পড়তে হবে। এজন্য প্রতিদিন নতুন কিছু খোজা এবং শিখা এরকম মেন্টালিটি নিয়ে তিনি নতুন দের কাজ করে যেতে বলেছেন।